Thursday, June 25, 2009

নিকোসি জনসনঃ জন্মই যার মৃত্যুর তরে দিন গোনার


দক্ষিন আফ্রিকার ডারবান শহরে ১৩তম বিশ্ব এইডস সম্মেলন (World AIDS Congress)অনুষ্ঠিত হলো ২০০০ সালে। এই সম্মেলন নানা কারণে ঐতিহাসিক। এই প্রথমবারের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোগের ওপর এই সম্মেলন। পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ এইচ, আই, ভি এবং এইডস রোগে আক্রান্ত যে মহাদেশে, সেই আফ্রিকায় একত্রিত হলো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সতের হাজার মানূষ। এরমধ্যে পৃথিবীর অন্যতম এইডস গবেষক থেকে শুরু করে, সমাজকর্মী, এজিও প্রতিনিধি, সেক্সওয়ার্কার বা যৌনকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, এইডস রোগী, ঔষধ কোম্পানী, নাট্যদল, সাংবাদিক, সরকারি প্রতিনিধি সকলেই ছিলেন। তাছাড়া এই সম্মেলনের আরেকটি বিশেষ গুরুত্ব একারনে যে ঔষধ কোম্পানিগুলো অত্যন্ত চড়া দামে এইডস এর ঔষধ বাজারজাত করায় পৃথিবীব্যাপী বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের এটাই সূবর্ণ সুযোগ। সবকিছু মিলিয়ে কোটি মানুষের অন্তরে এই সম্মেলন নিয়ে আগ্রহ এবং কৌতুহল।


এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর মানুষ বহু ঘটনা বা তথ্য জানার পাশাপাশি আরেকজন মানুষের কথা জানতে পারলোঃ তার নাম নিকোসি জনসন (Nkosi Johnson)। যে ক্ষুদে মানুষটি আকারে, শারীরিক শক্তিতে দূর্বল হওয়া সত্বেও পৃথিবীব্যাপী সকলেই তাকে এক নতুন অভিধায় অভিষিক্ত করলো, তা হলো ’সুপারম্যান’। ঘরে ঘরে, এইডস রোগের চিকিৎসা কেন্দ্রে, এন জি ও অফিসে, আন্তর্জাতিক সংস্থার কেন্দ্রগুলোতে, দেয়ালে, পোস্টারে ছোটদের সুপার হিরো চরিত্রগুলো যেমন ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের পাশাপাশি নিকোসি জনসনের ছবি টাঙ্ানো হলো। নিকোসি হয়ে উঠলো এইডস রোগীদের সংগ্রামের প্রতিক, দাবি আদায়ের মুখপাত্র। কিন্তু মাত্র এগারো বছরের এই বালকের ইতিহাস নিতান্তই করুণ এবং মর্মস্পর্শী।


নিকোসির জন্ম ১৯৮৯ সালে সাউথ আফৃকায়। নিকোসি পৃথিবীর সেই হতভাগ্য বত্রিশ লাখ শিশুদের একজন যারা হয় জন্ম সূত্রে এই মরণব্যাধির জীবানু এইচ, আই, ভি (HIV) -তে আক্রান্ত হয়েছে, না হয় জন্মানোর পর পরই মাত্র পনের বছর বয়েসের আগেই আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। নিকোসির জন্ম সাউথ আফৃকায়, যেখানে এইডস রোগের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। চৌদ্দ থেকে পঁচিশ বছর বয়েসের প্রতি দুইজনের মধ্যেই একজন এই মরণব্যাধির জীবানুতে আক্রান্ত, প্রতি দশ মিনিটে মৃত্যু হচ্ছে কোন একটি মানুষের, তার মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই সবচাইতে কর্মক্ষম বা সক্ষম বয়সসীমার মধ্যে। পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে যারা নতুন জীবনের পাশাপাশি মায়ের কাছে থেকে পাচ্ছে এইডস রোগের জীবানু। এই শিশুরা নিজের অজান্তেই পৃথিবীর রূপ- রস-গন্ধের স্বাদ পাবার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে তাদের বয়স পাঁচ বছর পৌছুতে না পৌছুতেই। নিকোসি এই হতভাগ্য শিশুদেরই প্রতিনিধি।


দ’হাজার সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে এইচ, আই, ভি আক্রান্ত এবং এইডস রোগীর সংখ্যা ৪২ মিলিয়ন বা চার কোটি বিশ লক্ষ। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এইচ, আই, ভি জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া মানেই এইডস রোগ নয়। কেউ কেউ এই আক্রান্ত অবস্থায় ছয় থেকে দশ বছর পর্যন্ত কোন রোগের লক্ষণ না নিয়ে থাকতে পারে এবং নিজের অজান্তেই এই রোগের জীবানু ছড়াতে পারে। এই রোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আফৃকা মহাদেশ। এই ৪২ মিলিয়ন আক্রান্ত লোকের মধ্যে প্রায় ৩০ মিলিয়ন বা তিন কোটি লোকই আফৃকা মহাদেশের, বিশেষ করে সাব-সাহারান আফৃকার। সাউথ আফৃকা এই সাব-সাহারান আফৃকার অর্ন্তভূক্ত। পৃথিবীতে প্রতিদিন ১৪ হাজার লোক নতুন করে এই রোগের জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এর শতকরা ৯৫ভাগই গরিব দেশগুলোর বাসিন্দা। তার মধ্যে দুই হাজার শিশু, বাকি বার হাজার লোক পনের থেকে উনপঞ্চাশ বছর বয়েসের। এই বার হাজার লোকের অর্ধেক নারী, বাকি অর্ধেকের বয়স মাত্র পনের থেকে চব্বিশের মধ্যে। অর্থাৎ পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর সবচাইতে কর্মক্ষম মানুষগুলো এই রোগে আক্রান্ত এবং উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন।


এইচ, আই, ভি-তে আক্রান্ত মায়ের কাছে থেকে শিশুর শরীরে জীবানু সংক্রমনের সম্ভাবনা শতকরা প্রায় ষাট থেকে সত্তরভাগ, বিশেষকরে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে। তার কারণগুলোর মধ্যে প্রসবের সময়ের জটিলতা, রক্তক্ষরণ, জীবানুমুক্ত পরিবেশের অভাব ইত্যাদি। মায়ের কাছে থেকে শিশুর শরীরে এই সংক্রমণের মাত্রা প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব যদি মা কে গর্ভধারণের পরে এ,জী,টি (AZT) নামের একটি ঔষধ দেয়া হয়। যেহেতু এই ঔষধের দাম অত্যন্ত চড়া এবং লম্বা সময় ধরে এটা দেবার দরকার হয়, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জন্য এই চিকিৎসার ব্যয় একেবারেই কল্পণার বাইরে। অথচ এই ঔষধের প্রকৃত দাম বাজার দরের চেয়ে কয়েকশ গুণ কম। ড্রাগ কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য সমস্ত মানবিকতা উপেক্ষা করে মাত্রাছাড়া দাম ধরে রাখার কারণে মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ, জন্ম নিচ্ছে অনেক শিশু এই মরণব্যাধি শরীরে ধারণ করে। শত শত মানুষের আকুতি, মানবধিকার সংগঠনের আবেদন, এইডস সম্পর্কিত নানা ফোরামের বহুবিধ দাবি সত্বেও কোম্পানিগুলোর মন টলেনি। তাই নিজের মাটিতে এই প্রথমবারের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানূষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। এই প্রতিবাদ বিক্ষোভের ভাষা রাজপথে মিছিল থেকে শুরু করে ড্রাগ কোম্পানীর স্টলে কালির আঁচড়ে, বিক্ষুদ্ধ পোস্টারে পর্যন্ত গড়ালো। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিবাদটি করলো মাত্র এগারো বছরের এই বালক নিকোসি জনসন।
তেরতম এইডস সম্মেলনের শ্লোগান ছিল, (Break the Silence) অর্থাৎ ’ভাঙ্গো নিরবতা’। এই শ্লোগানের মর্মার্থ তুলে ধরার জন্য দক্ষিণ আফৃকার আদিবাসীদের বিখ্যাত ’কাওয়াজুলু নাটাল’এর উন্মাতাল ঢোল-মাদলের তালে এক বর্ণিল নৃত্য-গীতময় উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপহার দিলো সাউথ আফৃকা। সাউথ আফৃকার প্রেসিডেন্ট থাবো মেবেকি এবং ইউ, এন, এইডস (UNAIDS) এর নির্বাহী পরিচালক ডক্টর পিটার পিয়ট বক্তব্য রাখলেন। তারপর মঞ্চে এলো এগারো বছরের বালক নিকোসি জনসন। কুচকুচে কালো, রুগ্ন শরীরে কালো রঙের ট্রাউজার, জ্যাকেট পরে বেশ দূর্বল কণ্ঠে নিকোসি জনসন যখন বক্তৃতা শুরু করলো, সারা স্টেডিয়াম জুড়ে তখন পিনপতন নিরবতা। হালকা বৃটিশ উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলছিলো নিকোসি জনসনঃ’জন্মের পরে বাবার নাম জানার আগেই আমি জেনেছিলাম আমার শরীরে এইডস-এর জীবানু আছে। বাবাকে কোনদিন চোখে দেখার সুযোগ হয় নি। তারপর মাকেও হারালাম এইডস রোগে। তবুও আমি এইডস -এ আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান কারণ আমার দত্তকগ্রহীতা মা (ফস্টার মাদার) গেইল জনসন আমাকে মায়ের মতো আদর দিয়েছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন শতশত শিশু এইডস রোগে মার যাচ্ছে। আমাদের বাঁচাতে হলে মাকেও চিকিৎসা দিতে হবে। মা আর শিশুকে আলাদা করা উচিত নয়।
আমাদের এইডস রোগ হলেও আমরা তো সাধারণ আর সব মানুষের মতো। দ্যাখো, আমাদের হাত, পা, চোখ আছে, আমরা তোমাদের মতোই মানুষ।’


নিকোসি জনসনের প্রতিটি কথা যেন মানুষের অন্তরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধছিলো। স্টেডিয়াম ভর্তি অসংখ্য মানুষ, পৃথিবীব্যাপী টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে থাকা বা রেডিওতে কান পেতে শোনা প্রতিটি মানুষের মন বেদনার্ত, নরোম হয়ে গিয়েছিলো তার বক্তব্যে। সম্মেলনে উপস্থিত বড় বড় নেতা, ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা মাথা নিচু করে ছিলো লজ্জায়। সভ্য জগতের আয়নার প্রতিবিম্বে যেন প্রশ্নবাণ নিয়ে জেগে উঠছিলো নিকোসি জনসনের রুগ্ন অথচ জ্বলজ্বলে দুটো চোখ, কিসের বড়াই এই সমাজ-সভ্যতার?
তারপর ইউরোপে, আমেরিকায় সর্বত্র আলোচনার ঝড় উঠলো। আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বব্যাংকসহ বহু সংগঠন চাপ সৃষ্ট করলো ঔষধ কোম্পানীগুলোর ওপর, প্রস্তাব দেয়া হলো সাবসিডির, যাতে ঔষধের দাম কমানো হয়। আগের তুলনায় দাম কমলোও বটে। কিন্তু হায়, এই কম দামের ঔষধ খেয়ে যাবার সৌভাগ্য হলো না নিকোসি জনসনের। ২০০১ সালের জুন মাসে মৃত্যর কোলে ঢলে পরলো সে। তবু নিকোসিই ছিলো সাউথ আফৃকার এইডস আক্রান্ত শিশুদের মধ্য সবচেয়ে দীর্ঘজীবি শিশু।


নিকোসি জনসনের ফস্টার মা, গেইল জনসন নিকোসির ম্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য আর বিশ্বব্যাপী এইডস আক্রান্ত শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যার নাম "Nkoshi's Heaven" ’ বা নিকোসির স্বর্গ। নিকোসির স্বর্গ তখনই সত্যিকারের স্বর্গ হবে যখন পৃথিবীর শিশুরা আর এইডস-এর জীবানু শরীরে নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে না, আক্রান্ত মা পূর্ণ চিকিৎসা পাবে, আর শিশুরা পাবে ঔষধ, আশ্রয়, সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা এবং মানবিক ভালবাসা। মৃত্যুর আগে বহু দেশে গিয়েছিলো নিকোসি জনসন, মানুষকে এইডস বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য। শেষ কথাটি বলেছিলো এভাবে, 'When I grow-up, I would like to lecture more and more people all over the world'’. অর্থাৎ যখন আমি বড় হবো তখন পৃথিবীব্যাপী আরও মানুষের কাছে পৌছে দেব আমার বক্তব্য।


নিকোসি জনসনের সেই ইচ্ছা পূরণের আর সুযোগ হয়নি। কিন্তু তার ইচ্ছেগুলো ছড়িয়ে পরেছে অসংখ্য মানুষের মনে। আমাদের দায়িত্ব নিকোসি জনসনের বক্তব্য পৌছে দেয়ার পৃথিবীর দুয়ারে দুয়ারে। আগামী ২০১০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি শিশু এতিম হয়ে যাবে এই এইডস রোগের কারণে। এই ভয়াবহ অবস্থা প্রতিরোধের এখনই সূবর্ণ সময়। এই দায়িত্ব পালনে আমরা যদি ব্যর্থ হই, নিকোসি জনসনের মতো অসংখ্য শিশুর রুগ্ন অথচ জ্বলজ্বলে চোখগুলো আমাদের তাড়িত করবে সর্বক্ষণ, কিসের বড়াই এই সমাজ-সভ্যতার? আমরা কি পারবো সেই বিবেকের দায় ভাগ এড়াতে?
* সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এ পূর্ব প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment