Monday, June 22, 2009

দুই বাংলার কবিতা সম্মেলনঃ অন্তর দুইভাগ হবার যন্ত্রণা


কোলকাতা নিয়ে আমার স্বপ্নচারিতা সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা মাঝে মাঝেই কোলকাতা যেতেন আর বড় ভাই-বোনদের দেখতাম কোলকাতার মাস্টার কোম্পানীর ইংলিশ প্যান্ট অথবা কোট পরতে। আমার ভাগ্যে তা কখনও জোটে নি। আমি ছিলাম ছ’ ভাই-বোনের মাঝে সবার ছোট। সোনার চামচ, রূপার চামচ ছাড়িয়ে আমার ভাগ্যে কাঠের চামচের মতো আবস্থা। বাবার কাছে মাঝে মাঝে কোলোকাতার গল্প শুনতাম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবীন্দ্রসদন, রেলওয়ে ইত্যাদি। তাছাড়া গল্প-উপন্যাস পড়ে পড়ে মনের মধ্যে কোলকাতা নিয়ে একটা আলাদা জগৎ, আলাদা স্বপ্নচারিতা। তাই যখন প্রথম কোলকাতা যাবার সুযোগ এলো আমার মনে তখন অন্যরকম আনন্দের দোলদুলুনি।
৯১’এর একুশের বই মেলায় আমার কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে একটি ছিলো ’অপারেশন জ্যাকপট’। মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার অকথিত গল্প নিয়ে এই বই। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের তুলন শহরে একটি পাকিস্তানি সাবমেরিনে ট্রেনিং-এ ছিলেন ১৩জন বাঙালি সাবমেরিনার। তাদের মধ্যে থেকে ৯ জন একটি সাবমেরিনসহ পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। সেই নয়জনের একজন ধরা পড়েন পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের হাতে এবং নিখোঁজ হয়ে যান। বাকি আটজন পালিয়ে এসে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় গড়ে তোলেন একটি গোপন সুইসাইড বাহিনী। যারা একসংগে চিটাগাং, মোংলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে আক্রমণ করে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করেন। এই নৌ-কমান্ডোদের অসাধারণ আত্নত্যাগের কাহিনী বিস্তারিত লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রায় দুবছর কাজের ফসল ’অপারেশন জ্যাকপট। ’অপারেশন জ্যাকপট’ ছিলো এই কমান্ডো আক্রমনের সাংকেতিক নাম। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের এই অধ্যায়টি বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশের কোথাও লেখা ছিলো না, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ষোল খন্ডের দলিলপত্রেও ভাসা ভাসা কয়েকটি সাক্ষাৎকার ছাড়া আর কোন বিবরণ নেই, আমি চিটাগাং পর্বটি নিয়ে প্রথম বইটি প্রকাশ করেছিলাম। এই বইয়ের ঘটনাটি বিস্তারিত লেখার উদ্দেশ্য হলো এর সংগে আমার কোলকাতা যাবার যোগসূত্র আছে।
অপারেশন জ্যাকপট-এর প্রথম পর্বটি সুধীমহলে ভালোভাবেই গৃহীত হলো। ডঃ হায়াৎ মামুদ লিখলেন বিচিত্রায়, মফিদুল হক লিখলেন আজকের কাগজের উপসম্পাদকীয়। তবে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন এরকম একটি প্রামান্যগ্রন্থকে আমি কেন কিশোর গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। উত্তরে হাসতে হাসতে বলতাম, ’যেহেতু বড়দের মস্তিস্ক ইতোমধ্যেই পচে গেছে, তাই তাদেরকে উদ্দেশ করে লেখার আর দরকার নেই, একমাত্র কিশোরেরাই পারবে নতুন কিছু করতে, নতুন পরিবর্তন আনতে’। যাহোক, অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে সবচেয়ে সুখকর ছিলো শওকত ওসমানের একটি ব্যক্তিগত চিঠি। ৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পনের তারিখে লেখা সেই চিঠির একটি অংশ তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছেনঃ ‘নাস্তি অপেক্ষা বিলম্ব শ্রেয়তর .....জাতীয় বড় দুঃসময়ে অনাবিস্কৃত আর এক জগত তুমি উন্মোচন করেছো দেশবাসীর সন্মুখে । নৌযুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামের এক দিক। কিন্তু তা স্পষ্ট কারো কাছে নয়, আমার কাছেও ছিলো না- বলতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। মুক্তিসংগ্রামের চেতনা যখন নানাভাবে মুছে দেয়ার চেষ্টা, তখন তোমার এই পুস্তকরূপী সাইরেন অনেককে দিশার পথ দেখাবে। .....অপারেশন জ্যাকপট-এর প্রচার বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।’
দেশের অন্যতম প্রধান লেখকের কাছে থেকে এই আশীর্বাদ আমার কাছে তখন অসাধারণ প্রেরণার সামিল। আমি অপারেশন জ্যাকপটের চার পর্ব লিখবো বলে স্থির করলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম ইন্ডিয়ার ’ফোর্ট উইলিয়াম’ সামরিক কেন্দ্রে এই ঘটনার দলিলপত্র আর্কাইভ করা আছে। তাছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে এই ঘটনার কিঞ্চিৎ আভাস দিয়েছিলেন, তাকেও জিঙ্গেস করতে চাই কোন খোঁজ খবর বা দলিলপত্র দিতে পারেন কিনা। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মফিদুল হক আমার একনিষ্ঠ উৎসাহদাতা। তিনি আগাম সম্মানীর নাম করে টাকা দিলেন কিছু। তিনি জানেন আমি নিতান্তই ছাত্র, তাকে কখনও কিছু খুলে বলতে হয়না, ভীষণ সহমর্মিতায় বুঝে নেন সব। তার প্রকাশনী সংস্থা থেকে ’বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ অভিযাত্রী’ শিরোনামে আমার আরেকটি বই বেরুবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই বইতে বিশ্বের দশজন শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রীর কথা বলা হবে যাদের মধ্যে একজন থাকতে হবে বাঙালি। বাঙালি অভিযাত্রী খুঁজতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত যাকে পেলাম তিনি হলেন রামনাথ বিশ্বাস। সত্তর বছর আগে যিনি বাই সাইকেল চড়ে বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু রামনাথের ওপর কোন তথ্য বাংলাদেশের কোথাও পেলাম না। জানলাম কোলকাতার কোথাও তার ওপর তথ্য পাওয়া যেতে পারে। ঠিক হলো এই দুই কাজ নিয়ে কোলকাতা যাব। ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে ভিসা নিতে গিয়ে কবি বেলাল চৌধুরীর সংগে দেখা। তিনি বললেন,আরে ভাল সময়ে কোলকাতা যাচ্ছো। ওখানে দুই বাংলার কবিতা সম্মেলন হবে। তুমি থাকবে আমাদের সংগে ছড়াকার হিসেবে। আমি বললাম,আমি তো আমন্ত্রিত নই, আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?তিনি আমার কথা নাকচ করে দিয়ে বললেন, বাংলাদেশের কবিদের দলে একজন ছড়াকার থাকার কথা, তুমি কনিষ্ঠতম বয়সে ছড়া সাহিত্যে শিশু একাডেমী পুরস্কার পেয়েছো, তুমি যাবে নাতো কে যাবে, হাঁ?আমি প্রচন্ড আনন্দের সংগে সায় দিলাম। এসব ঘটনা তখন আমার মনের মধ্যে তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি করেছে। আমি সমেশপুর নামের এক অখ্যাত গ্রামের ছেলে। সেখানে বসে যতই রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, তলস্তয়, কাম্যু বা কাফকা পড়ি না কেন দেশের এই স্বনামখ্যাত লেখক, কবিদের সাহচর্য আমার কাছে দূর্লভ প্রাপ্তির মতো। তাদের কাছে আমার প্রবেশাধিকার প্রতিনিয়ত অবাধ ও অবারিত হচ্ছে এই ভেবেই আমি অসম্ভব আনন্দ অনুভব করি। আমি কোলকাতা যাবার উত্তেজনায় রীতিমতো স্যুট, কোট পরে বাংলাদেশ বিমান বন্দরে হাজির হলাম।
’আবৃত্তিলোক’ নামের একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে দুই বাংলার কবিতা সম্মেলন হচ্ছে। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। এরমধ্যে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসেইন, আবৃত্তিকার ক্যামেলিয়া মুস্তাফা, মারিয়ম মান্নান এসে অপেক্ষা করছেন লাউঞ্জে। বেলাল চৌধুরী হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এই কবি দলের সংগে তসলিমা নাসরিনের যাবার কথা। এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন তার পাসপোর্ট আটক করেছে। ফর্সা, সুদর্শন বেলাল চৌধুরী রাগে লাল হয়ে ফোন করলেন কবি ইমরান নূর কে। কবি ইমরান নূর পেশায় বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট এর সচিব। তিনি জানালেন সরকারের উঁচু মহল থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাই কিছু করার নেই। সবাই এই ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করায় মন দিলেন। রফিক আজাদ বললেন, চলো ডিউটি ফ্রী শপ থেকে পছন্দের ’ড্রাই জিন’ কেনা যাক।
বিমান ছাড়লো ঢাকা এয়ারপোর্ট। বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই এটাই আমার প্রথম প্লেনে চড়া। ভেতরের ছটফটানি কাটিয়ে এয়ার হোস্টেজের দেয়া নাস্তার প্যাকেট শেষ করতে না করতেই ঘোষনা দেয়া হলো আমরা কোলকাতা পৌছে গেছি। আমি এতো নিরাশ আর কখনও হই নি। দম দম এয়ারপোর্টে পৌছে আমার আরও করুন অবস্থা; আমার মতো জবরজং পোশাকে আর কেউ নেই। আমি কেন যে কোলকাতা নিয়ে অন্যরকম একটা ধারণা করেছিলাম তা ভেবে বেশ বোকা বোকা লাগছিল নিজেকে। তাছাড়া প্রচন্ড গরম। আমি তাড়াতাড়ি কোট টাই খুলে ব্যাগে ভরলাম। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পুরো দলের রাজসিক ওয়েলকামের ভাগ আমিও পেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে কোলকাতা শহর প্রায় এক ঘন্টার ট্যাক্সি-পথ। এই এক ঘন্টা মনে হলো কয়েক যুগের সমান। তার কারণ দম দম এয়ারপোর্টের কাছে শহরের আবর্জনা ফেলার বিরাট ডাস্টবিন। সারাপথ ’এই দম বন্ধ, তারপর জীবন বাঁচাতে শ্বাস গ্রহন’ করতে করতে শহরে একটা রেস্ট হাউসে এসে উঠলাম। আমি বললাম, ’দম দমে এসে যদি দমই না নেয়া গেল, তাহলে তো বিপদ’। সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠলেন। কিন্তু আয়োজকেরা মনে হলো খুশি হলেন না। একটা বড় কনফারেনস রুমে সবাই অপেক্ষা করছি, বড় টেবিলের ওপরে রফিক আজাদের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে আনা কেনাকাটার ব্যাগটা রাখা। কেউ একজন হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন সেই ব্যাগ। ব্যাগে ছিলো সদ্য কেনা ড্রাই জিনের বোতল। মাটিতে পরেই ভাঙলো সেটা। রফিক আজাদ রেগে বোম, অনেকটা ’ভাত দে নইলে মানচিত্র খাবো’র বদলে ’ড্রাই জিন দে নইলে বাংলা খাবো’র মতো অবস্থা।
আমার গোড়া থেকেই নিজেকে অনাহূত মনে হচ্ছিলো। তাছাড়া আমার নিজের কাজের বিষয়গুলোও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই সুস্বাদু মাছ-ভাত-সব্জি দিয়ে খাবার সেরে আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম কোলকাতা নিউমার্কেটের কাছে ’ক্যাপিটাল রেস্ট হাউসে’। এখানে আমার নামে আগেই ঘর রিজার্ভ করে রেখেছেন পুস্তক প্রকাশক ও পরিবেশক পার্থ দা। আমি আমার কাজগুলোকে ভাগ করলাম দু’ভাগে; অপারেশন জ্যাকপট সংক্রান্ত যোগাযোগ এবং রামনাথ বিশ্বাসের ওপর তথ্য সংগ্রহ। জ্যাকপটের কাজের জন্য মূলত যোগাযোগ করবো তিন জনের সংগে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিধান রায়ের ছেলে রঞ্জন রায় এবং ’প্রতিক্ষণ’ প্রত্রিকার সম্পাদিকা স্বপ্না দেব। স্বপ্না দেব আমাকে রামনাথ বিশ্বাসের ওপর কিছু দূর্লভ বইয়ের সন্ধানও দেবেন। নিউ মার্কেট থেকে প্রতিক্ষণের অফিস বেশি দূরে নয়। অফিস বিলডিংটা পুরনো দিনের কোলকাতার আমেজ ধরে রেখেছে। আমি পৌছে নিজের পরিচয় দিলাম ’অফিস বয়ে’র কাছে। সোজা সম্পাদিকা স্বপ্না দেবের ঘরে ডাক পরলো। তিনি জানেন আমার আসার উদ্দেশ্য। স্বপ্না দেব মধ্যবয়সী, সুন্দরী, ব্যক্তিত্বপূর্ণ একজন মহিলা। আমি সদ্য মেডিকেল কলেজের গন্ডি পার হবার পথে। অপারেশন জ্যাকপটের কাজে এসেছি শুনলে সবাই ধারণা করেন একজন বয়স্ক লোককে, আমার মতো চ্যাংড়া কাউকে না। যা হোক, স্বপ্না দেবের রুমেই পরিচয় হলো অরুণ রায়, প্রিয়ব্রত রায়ের সংগে। এরা সবাই প্রতিক্ষণের সংগে দীর্ঘ দিন থেকে জড়িত। আমার কথাবার্তায় যথেষ্ঠ ঢাকা, সিরাজগঞ্জের টান এসে যায়। সেই টানের খেই ধারে স্বপ্না দেব বললেন,’তোমাকে তো মুড়ি-পিয়াজি খাওয়াতে হবে। ওহ , তুমি ঢাকার ছেলে, তোমরা তো আবার পিয়াজি বলো না, বলো পিয়াজু।’আমি ঠাট্টার ভংগিতে বললাম,’হ্যা, আপনারা জ্বী হুজুর! জ্বী হুজুর ! করতে করতে অভ্যাসটা সব জায়গাতেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের লোকেরা সংগ্রাম করতে করতে আর ’জ্বী বলতে পারে না, বলে ’জু‘।সবাই হেসে উঠলো। স্বপ্না দেব একগাদা মানুষের নাম, ফোন নাম্বার দিয়ে দিলেন। তাতে পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের লাইব্রেরিয়ান পর্যন্ত আছেন। বললেন, বইমেলায় প্রতিক্ষণের স্টলে এসো, আর যা দরকার হয় জানিও আমাকে। আমার কপাল ভাল, কোলকাতা বইমেলা হচ্ছে ঠিক একই সময়ে। মনে মনে ভাবলাম এখানে এসে পিয়াজু-মুড়ি খেতেই হবে। তারপর বের হলাম লিস্ট ধরে লোক খোঁজার ধান্ধায়।
আবৃত্তিলোকের প্রথম দিনের কবিতা সম্মেলন বেশ জমে উঠলো। পত্র-পত্রিকায় এটার ওপর আলোচনা। তবে ঐ সময়ে ’হেডলাইন’ নিচ্ছে তোলপার করা সব রাজনৈতিক ইস্যু। বাবরি মসজিদের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা চলছে চারিদিকে। আনন্দবাজার পত্রিকা তসলিমা নাসরিনের পাসপোর্ট আটক করা নিয়ে লিখছে। এই কবিতা সম্মেলন খুব মিডিয়া কাভারেজ না পেলেও একেবারে কমও আলোচনা হচ্ছিলো না। সৈয়দ শামসুল হকের প্রবন্ধ নিয়ে বেশ হইচই হলো। পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি-সমালোচক মন্তব্য করলেন যে বাংলাদেশের কবিতায় খুব বেশি শ্লোগান থাকে, অনেক সময় শিল্পগুণ রক্ষা হয় না। এগুলো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতের্কর বহু বোদ্ধাজন উÌস্থিত ওখানে, আমি রীতিমতো উপভোগ করি এই সুমধুর লড়াই আর নিজের কাজের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াই।এই সম্মেলনেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে পেলাম। অপারেশন জ্যাকপটের একটা কপি দিয়ে বললাম, এ বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই। তিনি আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে আসতে বললেন।
কবিতা সম্মেলনের দ্বিতীয়দিন বিকেলে ছড়া পাঠের আসর। বেলাল চৌধুরী বার বার বললেন যেন কোনভাবেই ’মিস’ না করি। তাছাড়া ছড়া পাঠের আসরে সভাপতিত্ব করবেন অন্নদা শঙ্কর রায়। তাঁর সঙ্গে দেখা করা এবং পাশে বসে ছড়া পাঠের সৌভাগ্য শুধু আমার কাছে কেন, যে কোন ছড়া-প্রেমীর জন্য রীতিমতো দূর্লভ বিষয়। মঞ্চের কাছে গিয়ে শুনলাম অন্নদা শঙ্কর রায় খুব অসুস্থ। আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি সরল দে। তিনিও প্রবীন অতি নমস্য ব্যক্তি। মঞ্চে ফরাস পাতা, তাতে একে একে পশ্চিম বাংলার ছড়াকারেরা এসে বসলেন। বাংলাদেশ থেকে আমিই একমাত্র ছড়াকার। এক সময় ডাক পড়লো আমার। আমার মাথায় তখন কবিতা বিষয়ক বিতর্ক এবং বাংলাদেশের শ্লোগান ধর্মী কবিতা বিষয়ক মন্তব্যগুলো ঘুর পাক খাচ্ছে। আমি প্রথমেই বলে নিলাম যে আমরা মাত্র দু’দশক আগে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি। ন’ বছর ধরে স্বৈরশাষণের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করে আমাদের কণ্ঠে এখন আর ফুল, পাখি, লতা-পারার ছড়া আসবে না। শিল্পের যে প্রায়োগিক দিক আছে তার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আমি আমার ছড়া পড়ছি। এই ভূমিকার পরে পড়লাম সেদিনই লেখা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছড়া, তারপর স্বৈরাচার বিরোধী ছড়া। কোলকাতার শ্রোতারা অসাধারণ। বিশেষ করে,
‘বাব্বা! আপনি হুজুর সব টাউটের আব্বা।
আপনি হুজুর চিজ হোতা হ্যায় চাল্লু
চামচাগিরির দোষ দিলে তখন তখন খোশ দিলে পা ধরে কন, তু তো মেরা জানে জিগার খাল্লু
আপনি হুজুর চিজ হোতা হ্যায় চাল্লু!!’
এই ছড়াটি পড়ার পর কেউ কেউ চিৎকার করে বলছেন, ’দাদা আরেকটা হয়ে যাক’। আমি নির্ধারিত সময় পার করে দিয়ে চার চারটা ছড়া পড়লাম। সবশেষে বললাম এবার ছোটদের জন্য ছড়া ’গুলতানি’। এই ছড়াতে একজন কিশোর সমানে গুলমেরে যাচ্ছে, যেমনঃ
’আইনস্টাইন সূত্র যেটা খুঁজে পেলেন মাথায়
সেটাই লিখে রেখেছিলাম বাজার হিশেব খাতায়;
দুদিন আগে হারিয়ে সেটা পেলাম তিরস্কার
হাত ছাড়া তাই হয়েই গেলো নোবেল পুরস্কার।'
........এই লম্বা ছড়াটির সংগে আরও ক’লাইন যোগ করলাম ঐ স্টেজে বসেই।
'পড়তে ছড়া আসতে আমার দেরি হলো আজ
জ্যোতি বসুর সঙ্গে ছিলো খুব জরুরি কাজ
অটোগ্রাফের জন্য ভীষণ হুড়োহুড়ি ভিড়
হাসিস কেন? হিংসা পেটে? গা করে চিড়বিড়? '
শ্রোতাদের কাছে অকল্পনীয় সাড়া পাওয়া গেল। সভাপতি সরল দে মন্তব্য করলেন, ’বাংলাদেশের ছেলে গোল মরিচের ঝাল’। দুই বাংলার কবিতা সম্মেলন শেষ হলো। সেদিন রাতেই রেস্ট হাউসে আড্ডা হচ্ছে। এখন সবাই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। কেউ যাবে শান্িতনিকেতন, কেউ পরিকল্পণা করছে দার্জিলং যাবার। আমার মাথায় কাজ ঘুরছে। সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম নিজের ডেয়ায়, ক্যাপিটাল রেস্ট হাউসে।
আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে বিশেষ কোন কাজ হলো না। তিনি অপারেশন জ্যাকপট বিষয়ে কোন তথ্যই দিতে পারলেন না। মাঝখান থেকে আমার বাড়তি একটা লাভ হলো। দেশ পত্রিকা তথা আনন্দ পাবলিশার্স-এর আঁকিয়ে সুব্রত চৌধুরী আমার কিশোর উপন্যাস ’তুষার মানব’ এর কভার ডিজাইন করে দিলেন। এর মধ্যে খবর পেলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রামনাথ বিশ্বাসের ওপর বই পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ হাই কমিশনে গিয়ে অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল। তাঁরা একটি চিঠি লিখে দিলেন সহযোগিতার বিশেষ আনুরোধ জানিয়ে। সেটি নিয়ে আলিপুর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা করলাম অসীম রায়ের সঙ্গে। তিনি কর্মচারী ইউনিয়েনের নেতা। সব ব্যবস্থা খুব দ্রুত হয়ে গেল। আমি এখন লাইব্রেরির স্কলার হস্টেলে থাকি। প্রতিদিনের চার্জ মাত্র দুই রুপী, তাতে আবার সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। রাতের বেলা একটু গা ছম ছম করে বটে। কিন্ত এমন সস্তায় থাকা-খাওয়া কোথায় পাই?
হস্টেলের পাশে টিনের শেডের নিচে একটি ছেলে প্রতিদিন রান্না করে। তার সঙ্গে গল্প জমিয়ে বেশ আটার রুটি, সব্জি ভাজি দিয়ে নাস্তা করি। কখনও দুপুরে খিচুরি-ডিম। ছেলেটি বাংলাদেশ শুনে কেমন চোখে যেন তাকায়। বলে আমার বাপ-দাদাও বাংলাদেশে ছিলো, এখানে চলে এসেছে অনেক আগে। ওর কখনও বাংলাদেশে যাওয়া হয়নি বলে খুব আক্ষেপ। বলে, আমার বাবার একজোড়া পালা-খাসি ছিলো, এখানে আসার সময় খাসি দুটো আনতে পারেনি বলে বাবার কি দুঃখ! মাঝে মাঝেই খাসি দুটোর কথা বলে ডুকরে কেঁদে উঠতো বাবা। বলতে বলতে ওর চোখ দুটোও কেমন ভিজে আসে। আমি স্তব্দ হয়ে বসে থাকি উনুনের পাশে। কোলকাতা বইমেলা বেশ জমজমাট। আমি প্রতিদিন বিকেলে বইমেলায় প্রতিক্ষণের স্টলে গিয়ে বসি। এখানে সব নামিদামি লোকজন আসেন। একদিন এলেন চলচ্চিত্রকার মৃনাল সেন, এলেন আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ, আরও কতজন। স্বপ্না দেব সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সবাই ঢাকার ছেলে বলে সস্নেহে কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরেন। ভীষণ ভালো লাগে আমার। কোলকাতায় আমি টানা এক মাস থাকলাম। এই এক মাসে কতো মানুষ, কতো ঘটনা! মেট্রো সিনেমা হলে গিয়ে ঠকের পাল্লায় পরা, রাজারবাগ এলাকায় হিন্দু-মুসলমান টেনশন, ডলার ভাঙ্গাতে গিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে আটকে পরা, রেল স্টেশনের মায়াবী তরুনী, বইপাড়া, আড্ডা, সব কিছু ছাপিয়ে আমার মনে জেগে থাকে আলিপুর লাইব্রেরির সেই কিশোর ছেলেটির যন্ত্রণাবিদ্ধ চোখ। ওর বাবার দুটো পালা-খাসি র জন্য কান্না তো একটা অজুহাত মাত্র। এ যে অন্তর দুই ভাগ হবার যন্ত্রণা, আপন ভিটে-মাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার ছাপ দেখেছি আমার বাবার চোখেও, যখন তার প্রিয় বন্ধুরা পাড়ি জমিয়েছিলেন কোলকাতায়। এই যন্ত্রণা এখনও বিদ্যমান, তা সেই কোলকাতার অভিজাত শ্রেনীর কোন সাহিত্য-প্রেমীর মাঝে অথবা আলিপুর লাইব্রেরির সেই কিশোর ছেলেটির বুকে। এই যন্ত্রণার ছাপ আমার বুকেও গেঁথে গেলো আজ।
*সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এ পূর্বপ্রকাশিত।

No comments:

Post a Comment