Friday, September 25, 2009

একজন হুমায়ূন আহমেদ এবং হায়রে বাংলাদেশ!

হুমায়ূন আহমেদ কে নিয়ে কথা বলতে গেলে বা লিখতে গেলে আমি এক ধরনের আবিস্কারের আনন্দ অনুভব করি। আজকে তাঁর প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা বা খ্যাতির বাইরে এক অন্য ধরনের আবিস্কারের আনন্দ, একজন মানুষকে আবিস্কারের আনন্দ। তাঁর লেখা নিয়ে হয়তো বা সবসময় একরকম মন্তব্য করবো না, কিন্তু আবিস্কারের সুখটুকু চিরকাল তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবো। কেন করি সেকথা শুনে আমাকে কেউ নার্সিসিস্ট বা আত্নপ্রেমিক বললেও কোন আপত্তি নেই। তবে এই স্বল্প পরিসরের লেখায় হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ কেন? তার কারণ সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত এবং যায়যায়দিনে পুনঃপ্রকাশিত তাঁর খুব ছোট্ট একটি লেখা হায়রে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে কিছু বলার আগে আমার আবিস্কারের গল্পটি বলে নিই।
ক্লাস এইটে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য স্কুল থেকে একগুচ্ছ বই পুরস্কার দেয়া হলো আমাকে। তার মধ্য অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য বই যা আমার জীবনকে পালটে দিতে সাহায্য করেছিল। জামতৈল নামের এক সাধারণ গ্রামের স্কুলে ছিলেন কয়েকজন অসাধারণ শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে মুজিবর রহমান বিশ্বাস ছিলেন লেখক-প্রাবন্ধিক। প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ স্কুলের শিক্ষক হয়েও সেই গ্রামে বসে ’উপনিষদের দার্শনিক মর্ম ও অন্যান্য আলোচনা’র মতো প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর বই সিলেকশন যে অন্যরকম হবে তা বলাই বাহুল্য। একসঙ্গে পাওয়া বিশ বাইশ টা বই আমি গোগ্রাসে গিলছি। সেখানে জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, চেঙ্গিস আইসমভের গল্প সংকলন। সেই সঙ্গে একজন নতুন লেখকের আনকোরা নতুন বই নন্দিত নরকে। তখন হুমায়ূন আহমেদের নামও শুনিনি। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে হু হু করে কাঁদছি। এক অবর্ণনীয় আনন্দের কান্না, কিশোর বয়েসের যুক্তিহীন আবেগের কান্না নয়, বরং এক পরিনত জীবনবোধের, জীবনকে স্পর্শসুখের আনন্দে কান্না। গ্রামের টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দে ঢেকে যাচ্ছিলো সেই কান্নার শব্দ, আর আমি বার বার বলছিলাম, এই লেখককে খুঁজে বের করতেই হবে।
ঢাকায় এলাম ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য। অনেকটা জীবিকার জন্যই গান লিখি, বেনামে পত্রিকায় ফিচার আর জিঙ্গল লিখি। জিঙ্গল হলো বিঙ্গাপনের গান। নগদ টাকা, তাছাড়া পরিশ্রমও কম। পাশাপাশি উন্মাদ পত্রিকায় মাঝে মাঝে খবর থেকে ছড়া লিখি। এই বিভাগে প্রকাশিত খবর নিয়ে আমার ব্যঙ্গাত্নক ছড়ার সঙ্গে কার্টুন আঁকেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। আহসান হাবীব বন্ধুত্ব্বের সূত্র ধরে একদিন বললেন যে প্রকাশনী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে চান তিনি। আমাকে পান্ডুলিপি দিতে বললেন। তারপর নিজেই তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় বললেন,’আপনার বই ছাপলে তো দেউলিয়া হতে হবে, তার চেয়ে এক কাজ করুন কয়েকজন বিখ্যাত লোকের গল্প নিয়ে একটা সংকলন বের করুন। সেটা দিয়ে ব্যবসা হবে। সেই সঙ্গে আপনার একটা মৌলিক বইও ছাপবো। এই বইয়ের লোকসান পুষিয়ে নেয়া যাবে অন্য বইটি দিয়ে।’
ঠাট্টা করে বললেও কথাটা তো তখন সত্যি ছিল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম কিশোর রহস্য গল্প সংকলনের কাজে। আমার উৎসাহ আরো বেশী, কারণ আমার মৌলিক ছড়াগ্রন্থ হাবিজাবি বের হবে একই সঙ্গে। তাছাড়া সেই প্রথম জানলাম লেখক হুমায়ুন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার সহোদর। যাকে সেই ছোটবেলায় খুঁজে বের করার পণ করেছিলাম তিনি হাতের নাগালে, এতো সহজে। আহসান হাবীব সাবধান করে দিয়ে বললেন,’আপনি সম্পাদক, আপনার দায়িত্ব আমার ভাইয়ের কাছে থেকে গল্প আদায় করা। এই কাজে সফল হওয়া অনেকটা পুলসেরাত পার হওয়ার সমান।’ পুলসেরাত পার হলাম। উননব্বই এর বইমেলায় শওকত ওসমান, শওকত আলী, রাহাত খান, হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন সহ দশজন গল্পকারের দশটি আনকোরা গল্প নিয়ে বের হলো কিশোর রহস্য গল্প। সেই সঙ্গে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আমার ছড়াগ্রন্থ হাবিজাবি।

রহস্য গল্প সংকলনটি একেবারে ব্যবসা-সফল প্রকাশনা হিসেবে বাজারে স্থান করে নিলো। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে বই পড়া যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো সেখানেও নির্বাচিত হলো বইটি। সেই সঙ্গে আমার প্রথম বই হাবিজাবি পেলো শিশু একাডেমী থেকে পুরস্কার। জন্ম হলো আজকের একটি সফল প্রকাশনী সংস্থা দিনরাত্রি প্রকাশনী। কিন্তু আমার কাছে এগুলোর চেয়েও বড় পুরস্কার কিশোর বয়েসের আবিস্কার করা সেই প্রিয় লেখকের পারিবারিক বন্ধুত্ব।
হুমায়ুন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন আমেরিকায় তখন প্রায়ই আহসান হাবীবের সঙ্গে তার কল্যানপুরের বাসায় যেতাম। সেখানে তার সঙ্গে থাকতেন এই ত্রিরত্নের মা। নিজের ছেলের মতো খাবারের পাতে কই মাছ তুলে দিতে দিতে আক্ষেপ করতেন, তাঁর বড় শখ ছিলো একটি ছেলে ডাক্তার হোক। আমি বলতাম খালাম্মা, ’আমরা চাই আর না চাই দেশে প্রতি বছর অন্তত বারশো ডাক্তার তৈরি হবে। সেটারও দরকার আছে, কিন্তু প্রতি বছর দেশ তো বারজন লেখকের জন্মও দিতে পারে না। ভালো লেখক জন্মায় যুগে যুগে।’ তিনি স্নেহ-মাখা শাসনের সুরে বলতেন এইজন্য লেখক হওয়ার আশায় মেডিক্যালের পরীক্ষা বাদ দিয়া বইমেলার কাজ করো, না?গল্প করতে করতে কখনও তিনি ’শাহীনের বাবার’ কথা বলতেন। শাহীন আহসান হাবীবের ডাক নাম। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক পিতার কথা বলতেন। একজন মুক্তিযুদ্ধের শহীদের কথা বলতেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বুকে গভীর, বিশাল এক ক্ষত আছে। কোন নিকটজন হারাবার বেদনার চেয়েও গভীর। নিকটজন হারানো এক ধরনের কষ্ট। তাতে কষ্টের নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এই কষ্টও বিশাল। কিন্তু কিছু কষ্ট, কিছু ক্ষত নিষ্পত্তিহীন। কী এমন কষ্ট যা নিকটজন হারানোর বেদনার চেয়েও গভীর, বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করে মনে? তার উত্তর আজ দিতে পারবো না। কেউ জিগ্যেস করলেও বলতে পারবো না। বলবো কোন একদিন সময় হলে। অন্যদিকে আজকাল এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানান রকমের ব্যবসা; মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ভন্ডামি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের পন্যের পসরা, মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে তুলে ফেলা হয় মুৎসুদ্দি মুদির দোকানদারি আর দালালদের ঝোলাতে। এই ক্ষত নিয়ে তাই যখনই কোন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত বা শহীদ পরিবারের সামনে দাঁড়িয়েছি তখনই অপরিসীম বেদনায় ছেয়ে গেছে মন। এজন্য বোধকরি কিশোর বয়েসে আবিস্কার করা লেখক লেখকের অধিক হয়ে ধরা দিতেন আমার মনে।
কাউকে ভালোবাসলেই একধরনের অধিকারবোধের জন্ম হয়। এই অধিকারবোধের কারণেই মনে হয় বার বার ছুটে গেছি হুমায়ুন আহমেদের কাছে। প্রশয়ও পেয়েছি তার কাছে। সেই শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের এ্যাপার্টমেন্ট, হাতির পুল বাজারের অপেক্ষাকৃত বড় এ্যাপার্টমেন্ট থেকে আজকের ধানমন্ডির প্রাসাদোপম বাড়ি, সবর্ত্রই অবাধ প্রবেশাধিকারের প্রিভিলেজ পেয়েছিলাম। প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষ বলেই তার কাছে থেকে আশা করতাম আরও বেশী। কিন্তু কখনও তাবেদার স্তুতিকারকে পরিনত হইনি। বরং প্রয়োজনে অন্য সবার চেয়ে সমালোচনায় উচ্চকিত হতাম তার সামনেই। অন্য সবার কাছে থেকে শুনতাম তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তিনি অহংকারী ইত্যাদি। আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করিঃ

তার মেফ্লাওয়ার সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। একদিন তার বাসায় গিয়েছি, ঠিক তখনই প্রকাশক লেখক কপি পৌছে দিলেন বাসায়। সেখান থেকে একটি কপি দিলেন তিনি । তখন হস্টেলে থাকি। বইটি পড়েই পেলাম একটি বড় তথ্যগত ভুল। লেখা আছে আমেরিকায় ডঃ ক্লার্কের বাসায় অনেক দূর্লভ জিনিসের মধ্যে দু’হাজার বছরের পুরনো কোরান শরিফের পাতা। হস্টেলের কয়েন বক্স থেকেই সাথে সাথে ফোন করলাম। কোরান শরিফের বয়সই তখন দুহাজার বছর হয়নি। তিনি বললেন ভালো বলেছো, এক্ষুনি পাবলিশারকে ফরমাটা নতুন করে ছাপতে বলি। কিম্বা কোথাও কেউ নেই নাটকের রিহার্সেল হচ্ছে বিটিভির একটি কক্ষে। হঠাৎ তুমুল বিতর্ক শুরু হলো। একপক্ষে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরীদি, সূবর্ণা মুস্তাফা অন্যদিকে হুমায়ুন আহমেদ। অভিনেতাদের বক্তব্য হলো টিভির বাংলা নাটকের একটি স্ট্যান্ডার্ড, শুদ্ধ ভাষা থাকা উচিত। হুমায়ুন আহমেদের বক্তব্য না, নাটকের ভাষা হবে আমাদের মুখের ভাষা। কথ্য ভাষা। দু’পক্ষেরই অকাট্য যুক্তি। কিন্তু কেউ মনে হচ্ছিল আসল কথাটা বলে নাট্যকারকে চটাতে চাচ্ছিলেন না। আমি সেখানে দর্শকমাত্র। আমার স্ত্রী, তৃষ্ণা মাহমুদ একজন অভিনয় শিল্পী ঐ নাটকে। আমি তার ড্রাইভার বলা যায়। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিতর্কে। হুমায়ুন আহমেদকে উদ্দেশ করে বললাম, ’নাটকে কথ্য ভাষা থাকবে ভালো, কিন্তু একেকজন একেকরকম কথ্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকলে একসময় ভাষাটাই একটা জগাখিচুরিতে পরিনত হয়। সাহিত্যের একটি বড় দায়িত্ব ভাষাকে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে দেয়া। তাছাড়া লোকভাষারও শুদ্ধ রূপ আছে। অথচ আমরা লোকভাষার নামে আঞ্চলিকতাদুষ্ট ভাষা ব্যবহার করছি। যেমন আপনার লেখায় শুনা, উঠা, পুড়ানো ইত্যাদি, সমাপিকা আর অসমাপিকা ক্রিয়ার উলটো ব্যবহার দেখা যায়।’হল ভর্তি লোক স্তম্ভিত আমার স্পর্ধা দেখে। আমি বুঝতে পারছি না বাসায় যতই হুমায়ুন ভাই বলি না কেন, এতো লোকের সামনে এভাবে বলাটা ঠিক হলো কি না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যা, সেজান ঠিকই বলেছো। আমার লেখার এটা ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার দোষ। সেদিন থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলো।
তার কাছে অন্যায় আবদারও করেছি কখনও। যেমন কোথাও কেউ নেই নাটকে আমার স্ত্রী তৃষ্ণা তিন কন্যার একটি চরিত্র রূপায়ন করছিলেন। একবার পত্রিকায় খবর বের হলো যে এই চরিত্রটি বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেবে। এখবর বের হবার পর হাসপাতালের গাইনী বিভাগের রোগীরা পর্যন্ত বেঁকে বসলো। তৃষ্ণা তখন মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনী বিভাগে ইন্টার্নি করছিল। তাদের সোজা বক্তব্য, ’আপা আপনে যদি মিথ্যা স্বাক্ষী দেন তাহলে আপনার হাতের চিকিৎসা নিবো না’। মহা মুশকিল! সেটা এমন পর্যায়ে গড়ালো যে একদিন তৃষ্ণা এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে আমাকে বললো, তুমি হুমায়ুন ভাইকে বলো যেন আমার চরিত্রটিকে দিয়ে স্বাক্ষ্য না দেয়া হয়। আমি ভীষণ অবাক। কারণ ওর মনের জোর আমি জানি। বাংলাদেশের মতো সামাজিক অবস্থায় টিভি নাটকে একজন কলগার্লের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য যে কি ধরনের অবস্থার সন্মুখিন হতে হয় তাও জানি। এমনকি মেডিকেলে পড়া ক্লাসমেটরা যখন সিটি বাজিয়ে বলতো, রেট কতো? তখনও ওকে বিচলিত হতে দেখিনি। বরং বলতো, ওদের জন্য আমার করুনা হয়। দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত লোকগুলোর যদি এই মেন্টালিটি, তাহলে রিক্সাওয়ালাদের কি দোষ? সেই মানুষ এতোটা ভেঙ্গে পরেছে। বললাম, তুমি তো জানো এটা বলাটা উচিত না। তুমি গ্রুপ থিয়েটার করা মানুষ হয়ে কীভাবে এটা বলতে বলছো? উত্তরে বললো, আমি জানি, আমি অভিনয়ের চেয়ে ডাক্তারি করাই বোধহয় বেশী ভালোবাসি। দুজনে সোজা হুমায়ুন আহমেদের বাসায় হাজির হলাম। সব শুনে তিনি বললেন, তুমি ডাক্তার না হলে হয়তো এটা করতাম না। গরীব দেশ, অশিক্ষার দেশ, এখানে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। তিনি স্ক্রীপ্ট পালটে দিলেন। অন্যায় আবদার করার জন্য যে ভার বুকে চেপে ছিলো মুহূর্তেই তা নামিয়ে দিলেন তিনি।
এভাবেই আবিস্কার আর ভালোবাসার দাবিতে, কখনও একপাক্ষিকভাবেই তার কাছে অধিকার ফলিয়েছি। কখনও লেখা পড়ে আশাহত হলে চিৎকার করে বলেছি ’হেকনিক প্লট’। কিন্তু কখনও বিশ্বাস হারাইনি তার ওপর থেকে। একবার সেরকম হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমার এক ঘনিষ্ঠবন্ধু এসে বললো ’যে হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে বড় বড় কথা বলিস তিনি তো ঢাকা ভার্সিটিতে জামাতের হয়ে ইলেকশন করছেন’। আমি ইউনিভার্সিটির এইসব রাজনীতি বুঝি না। তাই কথাটাকে তাৎক্ষিনিকভাবে বিচার করতে পারছিলাম না। সে বছরই বইমেলায় প্রকাশিত আমার কিশোর উপন্যাস তুষার মানব উৎসর্গ করেছি হুমায়ূন আহমেদকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম ’ কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ, যাঁর নিঃশঙ্ক হাত ধরে পৌছে যাই আমাদের নন্দিত নরকে’। একজন লেখক জানেন একজন লেখকের উৎসর্গ কতখানি গভীর অনুভব থেকে উৎসৃত। এই বইয়ের একটা কপি নিয়ে সোজা তার বাসায় হাজির হলাম। তাকে দিলাম বইটি। নেড়ে চেড়ে দেখে বললেন,

-থ্যাঙ্ক ইউ। খুব ভালো প্রোডাকশন। বিক্রী-টিক্রী হয়?
বললাম,

-বেশ হয়। কিন্তু আমি শুধু এ বইটি দিতে আসিনি। আজকে আমার একটা প্রশ্ন আছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

-বলো কি প্রশ্ন।

সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-শুনেছি আপনি নাকি ভার্সিটিতে জামায়াতের হয়ে ইলেকশনে দাড়িয়েছেন? কথাটা ঠিক কি না? তাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই বললাম, আমার বইটি উৎসর্গ করেছি আপনাকে। আপনি বড় লেখক। এরকম উৎসর্গপত্র শত শত পেতে পারেন। কিন্তু এটা আমার কাছে অনেক বড়। আপনার উত্তর যদি ’হ্যাঁ’ হয় তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা নতুন ঘটনা ঘটবে। আমি প্রেস ক্লাবে গিয়ে প্রেস কনফারেনস করে আমার উৎসর্গপত্রটি তুলে নেবো। মানুষ জানবে একজন ক্ষুদ্র লেখক তার প্রতিবাদ জানিয়েছে তার উৎসর্গপত্র তুলে নিয়ে।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে সোজা উত্তর দিলেন, বললেন -না।

আমি আবার ভারমুক্ত হলাম। একজন স্পর্শকাতর মানুষের জন্য সবচেয়ে কষ্টের কাজ হলো কাউকে শ্রদ্ধার আসন থেকে টেনে নামানো। আমাকে তা করতে হয়নি। আমাকে হারাতে হয়নি তার প্রতি আমার বিশ্বাস।
সেদিন ভাবী বললেন রাতের খাবার খেয়ে যেতে। খাওয়ার পর সবাই গল্পে মশগুল। খেয়াল করি অনেকক্ষণ তার কোন সাড়া-শব্দ নেই। আমি ড্রয়িং রুমে এসে দেখি কেউ নেই। সেই রুমে কোন ফার্নিচার ছিল না। অনেকগুলো কুশন ছড়ানো, আর নিচু একটা টেবিলে তার লেখার কম্পিউটার। মেঝেতে বসেই লিখতেন তিনি। কাঁচের স্লাইডিং ডোর খুলে দেখি রাতের ব্যস্ত ঢাকা, হাতিরপুল বাজারের শোরগোল, আর এরমধ্যেই অন্ধকার বারান্দার এককোনে হাঁটু ভাজ করে গুটিশুটি মেরে বসে আছেন তিনি, দূরে কোথাও তাকিয়ে। চারপাশের আলোর আভায় পাশে থেকে দেখতে পাই তার চোখ ভেজা। কাঁদছেন হুমায়ুন আহমেদ। আমাকে দেখার আগেই আমি নিঃশব্দে সরে আসি। একজন লেখকের কতরকম যন্ত্রণা থাকে! অসংখ্য মানুষের জীবনের কষ্টকে বুকে ধারণ করে, নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে তুলে আনতে হয় শিল্পের হীরকখন্ড, নিজেকে ভাঙতে হয়, গড়তে হয় কত না অজানা বেদনায়। কারো কি চোখে পরে সেই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ?
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী, যিনি তার গাড়িতে বাংলাদেশের রক্ত খচিত পতাকা উড়িয়ে প্রতাপের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, সেই ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা বীরদর্পে ছাত্র শিবিরের সম্মেলনে বললেন একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোন ভুল করেনি। বিদেশের মাটিতে বসে এই সংবাদ পড়ে রাগে-দুঃখে স্তব্দ হয়ে বসেছিলাম। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো বা ছুটে যেতাম তার কাছে। আপনার মতো শক্তিশালী লেখক, শহীদের সন্তানও কি নিশ্চুপ থাকবে? তাহলে দেশের বিবেকেরা কোথায়? কিছুদিন আগে যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রীদের ওপর নির্বিচারে লাঠি চালিয়ে ছিলো পুলিশবাহিনী, সেদিন সবচাইতে শক্তিশালী লেখাটি লিখেছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আজকে এদের কেউই কি জেগে নেই? এরকম ভাবতে ভাবতে, বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে কিছুই করতে না পারার কষ্টে লেখার জন্য কম্পিউটার টেনে নিয়েছি। ঠিক তখনই চোখে পড়লো প্রথম আলোতে তার লেখা ’হায়রে বাংলাদেশ’। ছোট্ট, ধারালো, তীব্র একটি লেখা। তিনি আবারও বাড়িয়ে দিলেন তার নিঃশঙ্ক হাত, আবারও জাগিয়ে দিলেন জাতির বিবেক। একজন সত্যিকারের লেখক কখনও পারেন না বিবেকের দায়ভাগ এড়াতে। এক হতভাগা দেশ, হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার জন্য আপনার এই বিবেক যেন চিরকাল জাগ্রত থাকে, এ আমার ভালোবাসার দাবী। হুমায়ুন আহমেদ, আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ।

*লেখাটি সাপ্তাহিক যায় যায় দিন এ পূর্ব প্রকাশিত

পুনশ্চঃ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পর অনেক পাঠক ইমেইল করে জানতে চেয়েছিলেন সেদিন হুমায়ূন আহমেদ কে কাঁদতে দেখা মানে কি তিনি আসলে অপরাধবোধ থেকে কেদেছিলেন কি না। আমার উত্তর, না। আমিও তা বলতে চাই নি। আমি শুধু একজন লেখকের কষ্টকে ইঙ্গিত করেছিলাম, সৃষ্টির পেছনের যন্ত্রণাকে নির্দেশ করেছিলাম।
সে. মা.


কোথাও কেউ নেই নাটকের লিংকঃ


Saturday, September 5, 2009

সোয়াইন ফ্লু চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ বাংলাদেশের জন্য কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পদক্ষেপ

[ সেপ্টেম্বর ১, ২০০৯ তারিখে খবর ডট কম-এ সোয়াইন ফ্লু ইনফেকশন নিয়ে উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের কীভাবে চিকিৎসা করা উচিত, বিশেষ করে শিশু বা গর্ভবতী মাদের, তা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। গত সেপ্টেম্বর ২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুই বিশেষজ্ঞ দুই রকমের মতামত দিয়েছেন। একজন বলছেন এক বছরের নিচের শিশুদের এটা চিকিৎসা দেয়া যাবে না, অন্যজন বলছেন যাবে। এই দ্বিমতের মূল কারণ সর্বশেষ নির্দেশনা না জানা। মূলত এই বিতর্ক নিরসনের জন্যেই লেখাটি লিখেছিলাম। এই লেখা পড়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক তরুন চিকিৎসক ইমেইল করেছেন, ফেসবুকে অনুরোধ করেছেন যেন ছোট-বড় সবার চিকিৎসার নির্দেশনা নিয়েই যেন একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা লিখি, তাতে অনেকেই উপকৃত হবেন। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ও ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফ, ডি, এ) ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ভিত্তিতে এই লেখা মূলত চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য লিখলাম। তবে সাধারণ পাঠকেরাও উপকৃত হবেন- সেজান মাহমুদ]

বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইচ ওয়ান এন ওয়ান (H1N1) ভাইরাস বা সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের প্রকোপ দেয়া দিয়েছে। বাংলাদেশেও আজ পর্যন্ত ২৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এখানে মনে রাখতে হবে যে এই ২৪৮ জন বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে চিহি¡ত রোগি। এর বাইরেও অনেক রোগী আছেন একথা ধরে নেয়া অসমীচীন নয়। বাংলাদেশের মতো উষ্ণ জলবায়ু, আদ্রতা বা হিমিডিটি এবং ঘনবসতির জন্য এই ভাইরাস ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে ’হাই রিস্ক’ বা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। এই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন, পাঁচ বছরের নিচের শিশু, গর্ভবতী মা, বয়স্ক ব্যক্তি যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি যাদের কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাঁপানী, হূদরোগ, কিডনীর রোগ, এবং এইডস আছে। বিশেষজ্ঞজনেরা এর মধ্যে ভবিষ্যতবাণী দিয়েছেন যে এই ভাইরাস ধীরে ধীরে পৃথিবীর উত্তর বলয়ে ব্যাপক আকারে আক্রমণ করবে। তবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা দেয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। সরকার ইতোমধ্যে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তার অসম্পূর্ণতা না সম্বনয়হীনতা যেন দ্রুত অতিক্রম করা হয় এই আবেদন করবো এবং এখানে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে দ্বিমতগুলো দেখা দিয়েছে তার উত্তর দেবার চেষ্টা করবো। যেহেতু এই ভাইরাস সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো কাশি, হাঁচি বা ভাইরাসে দূষিত বস্তুর সংস্পর্শে বা আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ বা নাকে সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এর প্রতিরোধের জন্য সাধারণ নিয়মগুলো জনগণের মধ্য ব্যাপকহারে প্রচার করা জরুরি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশি বা হাঁচির সময় নাক ও মুখ ঢেকে রাখা, ঘন ঘন হাত সাবান দিয়ে ধোয়া, বিশেষ করে কাশি বা হাঁচির পর; চোখ, নাক, মুখ হাত দিয়ে না ধরা, অসুস্থ হলে (ফ্লু'র মতো) কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা ঘরে থাকা, খুব জরুরী না হলে বাইরে বের না হওয়া, ঘর-বাড়ির সাধারণ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো স্বল্প সুবিধার দেশে শুধু লক্ষণ থেকেই উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের চিকিৎসা দেয়া জরুরী। প্রথমে এই শ্রেনীর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের চিকিৎসার নীতি কি হবে?



এক. ট্যামিফ্লু (ওসেলটামিভির) শুধু মাত্র এক বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিশুদের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে এক বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকর নয়। যেহেতু এক বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই সোয়াইন ভাইরাস মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে তাই তাদেরকে নিম্নোক্ত চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে বলে অতি জরুরি অনুমোদন দেয়া হয়েছেঃ

  • তিন মাসের কম বয়সী শিশুদের ১২ মিলি গ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য

  • তিন থেকে পাঁচ মাসের শিশুদের ২০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য

  • ছয় থেকে এগারো মাসের শিশুদের ২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য
এখানে মনে রাখতে হবে যে এই শিশুদের চিকিৎসা করতে হবে গভীর পর্যবেক্ষনের সঙ্গে যাতে যে কোন প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে নিচের লক্ষণগুলো দেখলেই জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবেঃ
  • শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস

  • চামড়া নীল হয়ে যাওয়া বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া

  • শিশু যদি যথেষ্ঠ পরিমানে দুধ বা পানীয় পান না করে

  • বার বার বমি করা

  • মাত্রাতিরিক্ত ঘুমানো বা নেতিয়ে পড়া

  • মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে থাকা

  • ফ্লু'র লক্ষণ প্রশমিত হয়ে আবার জোরালো ভাবে জ্বর ও কাশিসহ ফিরে আসা

দুই. আঠারো বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর কমানোর জন্য কোন ভাবেই অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা যাবে না। প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রুফেন দেয়া যেতে পারে।
তিন. গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের অনেক ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে। এ কারণে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা করা জরুরী। যদিও ওসিলটাভির ও জানামিভির এই দুটো ওষুধ গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে কখনও পরীক্ষা করা হয় নি কিন্তু এই দুটো ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকারক নয়। এর মধ্যে ট্যামিফ্লু বা ওসিলটাভিরই বেশি নির্ভরযোগ্য।

চার. এইচ আই ভি তে আক্রান্ত রোগীরা অন্য সাধারণ মানুষের মতোই সমান ঝুকিপূর্ণ। কারণ যদিও এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে কিন্তু সিডি৪ নামক প্রতিরোধের নিয়ামকটি সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে তেমন ভূমিকা রাখে না। তাহলে এরা কেন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ? এর কারণ সোয়াইন ফ্লু থেকে যে অন্য জটিলতাগুলো দেখা দেয় যেমন নিউমোনিয়া, তা ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে, এমন কি জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এজন্য এইচ আই ভি আক্রান্তদের এন্টিভাইরাস ঔষধ দেয়া জরুরী, তার চেয়েও জরুরী এদের অন্য সাধারণ চিকিৎসা ঠিক রাখা, যেমন সিডি৪ নম্বর ২০০ এর ওপরে রাখা, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করানো ও অন্যান্য সহযোগী চিকিৎসা ঠিক রাখা। এক্ষেত্রে ওসিলটাভির ও জানামিভির এই দুটো ঔষুধ ব্যবহার করা যাবে।

পাঁচ. বড়দের ক্ষেত্রে ফ্লু'সহ নিচের লক্ষণগুলো দেখলেই জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবেঃ
  • শ্বাসকষ্ট বা ছোট ছোট শ্বাস প্রশ্বাস

  • বুকে বা পেটে ব্যথা

  • হঠাৎ মাথা ঘুরানো

  • মানসিক বিভ্রান্তি

  • বেশি বেশি বমি হওয়া

  • ফ্লু'র লক্ষণ প্রশমিত হয়ে আবার জোরালো ভাবে জ্বর ও কাশিসহ ফিরে আসা
বড়দের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য ওপাত্ত থেকে নিম্নোক্ত ডোজে চিকিৎসা এমনকি প্রতিষেধমূলক (প্রফাইলেক্সিস) চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। প্রতিষেধমূলক চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে তাদেরকে যারা কোন সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন বা শারীরিকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে প্রথম সংস্পর্শে আসার দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত চিকিৎসা নিম্নোক্ত পরিমানে দিতে হবে। তবে যদি কোন রোগীর রোগের সাতদিন পার হবার পরে সংস্পর্শে আসা-হয় তবে আর প্রতিষেধমূলক (প্রফাইলেক্সিস) চিকিৎসার পয়োজন নেই।


ওষুধের নাম চিকিৎসা
ট্যামিফ্লু বা ওসেলটাভির পরিনত বয়সঃ
৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাপ, দিনে দু’বার পাঁচ দিন

প্রতিষেধমূলক চিকিৎসা
- ৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাপ, দিনে একবার
শিশুঃ এক বছরের বেশি
১৫ কেজি বা কম ওজন
চিকিৎসাঃ ৬০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ - ৩০ মিলিগ্রাম দিনে একবার
১৬-২৩ কেজি
চিকিৎসাঃ ৯০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ -৪৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার
২৪-৪০ কেজি
চিকিৎসাঃ ১২০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ -৬০ মিলিগ্রাম দিনে একবার
>৪০ কেজি
চিকিৎসাঃ ১৫০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ - ৭৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার
জানামিভির পরিনত বয়স
চিকিৎসাঃ দুইবার ৫-মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে দুবার
প্রতিষেধমূলকঃ -দুইবার ৫মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে
টেনে নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে একবার
শিশু সাত বছর বা বেশি
চিকিৎসাঃ দুইবার ৫-মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া
(১০মিলি মোট) দিনে দুইবার

প্রতিষধমূলকঃ দ-৫-মিলিগ্রামশ্বাসের সঙ্গে টেনে
নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে একবার
চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে সব রোগীর জন্য এই ব্যয়বহুল ওষুধের প্রয়োজন নেই। একজন ডাক্তার রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, অন্যান্য রোগের সহাবস্থান, উপসর্গের মাত্রা ইত্যাদি বিবেচনা করে এই চিকিৎসা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেবেন। সোয়াইন ফ্লু চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে একথাও বলা জরুরী যে কোন অবস্থাতেই আতঙ্কিত না হয়ে সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া খুব গুরুর্ত্বপূর্ণ। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্য অনেক যুগের মতো এই সোয়াইন ফ্লু’কেও জয় করা সম্ভব হবে। এই প্রত্রিয়ায় সকলেই সামিল হোন।

সেপ্টেম্বর ০১-০৩

লেখকঃ
সহযোগী অধ্যাপক, জনস্বাস্থ্য
ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথ
ফ্লোরিডা এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটি, ইউ, এস, এ।

অতিরিক্ত তথ্যের জন্য পড়ুনঃ



http://www.fda.gov/downloads/Drugs/DrugSafety/InformationbyDrugClass/UCM153546.pdf










Saturday, August 15, 2009

সেলিম আল দীনঃ কিছু স্মৃতি কিছু প্রশ্ন


গত সোমবার (জানুয়ারি ১৫, ২০০৮) আধুনিক বাংলা নাটকের অন্যতম পুরোধা, বাংলা নাটককে বিশ্বমানে উন্নীত করার অগ্রগণ্য সৈনিক সেলিম আল দীন মৃত্যুর সংগে লড়াই করতে করতে অবশেষে চিরদিনের মতো চলে গেলেন। চলে গেলেন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, ভক্ত, অনুরাগী, প্রিয়জন, সর্বোপরী বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিশালী ধারাকে কিছুকালের জন্যে হলেও কান্ডারীবিহীন করে দিয়ে।


এ্যাংলো-আইরিশ নাট্যকার, লেখক অস্কার ওয়াইলড একবার বলেছিলেন, ’এই পৃথিবী এক নাট্যশালা, কিন্তু এর পাত্রপাত্রি নির্বাচন করা হয়েছে একদম বাজে ভাবে ’। নাটকান্তপ্রাণ সেলিম আল দীন একথা খুব ভালোভাবে জানতেন বলেই বোধহয় কখনও রাজনীতি বা ক্ষমতা নিয়ে কোন ধরনের টানাহেচরাতে যেতেন না। বরং নিভৃতে, নিরালায়ে গবেষক, ধ্যানীর একাগ্রতা নিয়ে কাজ করে গেছেন আপন মনে। আর তারই ফলশ্রুতিতে ’কেরামত মঙ্গল’, ’চাকা’, ’হাত হদাই’, ’যৈবতী কন্যার মন’, ’বনপাংশুল’, ’প্রাচ্য’, ’নিমজ্জন’ বা ’স্বর্ণবোয়াল’ -এর মতো আধুনিক, বিশ্বমানের নাটকের জন্ম।
সেলিম আল দীনের সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় সেই আশির দশকের শেষদিকে তাঁরই এক ছাত্র ’রাজু’র মাধ্যমে। আমরা তখন ’ডকুমেন্টারি ড্রামা’ বা ’কমিউনিটি থিয়েটার’ এর ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য-শিক্ষাকে একেবার সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া যায় কিনা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে চায়ের কাপে ঝড় তুলি। রাজুই একদিন বললো, ’আমি সেলিম স্যারের কাছে তোমাদের গল্প করেছি, তিনি জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটির বাসায় নেমন্তন্ন করেছেন।’ তখন তৃষ্ণা আর আমি নিমগ্ন প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনিতেই পুরনো ঢাকার মেডিক্যাল কলেজের গন্ডি পার হয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। সেদিন জাহাঙ্গীর নগরে সেলিম ভাইয়ের বাসায় সারাদিন কাটিয়েছিলাম। প্রথম পরিচয়ে মানুষ যে এতোটা কাছে টেনে নিয়ে পারেন আমার ধারণা ছিলো না। গল্প, নাটক নিয়ে আলোচনা চললো; তখন আমিও টগবগে তাজা তরুন, তড়িৎ গতিতে কথায় চলে আসে ইস্কিলাস, মলিয়ের, কাম্যু, আরও কত কি! খুব গর্বের সংগেই বলি, সেলিম ভাই ভীষণ পছন্দ করেছিলেন সেই একদিনেই। নিজের হাতে নিজের রোপা গাছ থেকে পেয়ারা এনে খাওয়ালেন। সেলিম ভাই এবং ভাবীর গাছ লাগানোর শখ ছিল খুব।তারপর থেকে শুধু যোগাযোগ একটা সম্পর্কে দাড়িয়ে গিয়েছিল খুব কম সময়েই। তাঁর সংগে সম্পর্কের একটি ঘটনা না বললেই নয়, তার কারণ এটি আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় ঘটনার একটি। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেলিম ভাইয়ের ধারাবাহিক নাটক হচ্ছে, ’ছায়াশিকারী’। তৃষ্ণা তাতে একটি চরিত্রে অভিনয় করছে। নাটকের রিহার্সেল হবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি রুমে। ফোনে কথা বলার সময় সেলিম ভাই বললেন তুমিও চলে আসবে রিহার্সেলে। আমি বললাম, আমি কেন? আমি হয়তো তৃষ্ণাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো। সেলিম ভাই বললেন, না, তুমি থাকবে এই রিহার্সেলে, তোমার কাজ হবে ক্যারেক্টারগুলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যাখ্যা করে দেয়া। এ আবার কেমন কথা? কোন নাট্যকার কি এটা করেন? এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন সেই সময়ের সব প্রতিশ্রুতিশীল, এখনকার স্বনামখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, শহীদুজ্জামান সেলিম, আফসানা মিমি, নাদের চৌধুরীসহ আরও অনেকে। নাটকের কোন চরিত্র কেমন হবে না হবে এগুলো নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আমি বললাম, ‘এই নাটকটিকে গুন্টার গ্রাসের টিনড্রামের সংগে তুলনা করলে কেমন হয়? সেখানে যেমন প্রধান চরিত্রটি প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ঘোষণা করে সে আর বড় হবে না, অর্থাৎ প্রতিবন্ধী থেকে যাবে, এখানেও নাটকের প্রত্যেকটা চরিত্র কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী, একধরনের সীমাবদ্ধতায় বন্দী, এটাও একধরনের প্রতিবাদ। তারপর যার যার অবস্থান থেকে চরিত্রায়ন করা যায়।’সেলিম ভাই আমার মনতব্য ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। বলেছিলেন তুমি ঠিক আমার মনের কথাটি ধরে ফেলেছো। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। এই নাটকে একটি চরিত্র ছিল অন্ধ একজন শিল্পীর। সেলিম ভাই বললেন, এই চরিত্রে সেজান অভিনয় করো। আমি জানি যারা এটা শুনেছিলেন ঐ সময়ে তারা নিশ্চয়ই অবাক ও ঈর্ষান্নিত হয়েছিলেন। আমি নিজেও জানি না তিনি কেন এটা বলেছিলেন, এবং এটা যে কথার কথা ছিল না তাও প্রমানিত যখন তিনি রিহার্সেলের পরেও কয়েকবার বলেছিলেন তার মধ্য দিয়ে। আমি বলেছিলাম, ’সেলিম ভাই, আমি পর্দার আড়ালে থাকার মানুষ। তাছাড়া আমি নাটকে আভিনয় করলে আমি একবারেই শেষ, আর না করলে আমি সারা জীবন বলতে পারবো বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার আমাকে তাঁর নাটকে আভিনয় করতে বলেছিলেন। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’ সেই চরিত্রটি পরে খ্যাতিমান অভিনেতা বুলবুল আহমেদ চরিত্রায়ন করেছিলেন।এরপর বিদেশে চলে এলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো টেলিফোনে। একবার তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী পালন হলো ঘটা করে। আমরা আমেরিকা থেকে ফোন করি তাঁর বাসায়। এতোদিন পরেও ’সেলিম ভাই, শুভ জন্মদিন, হ্যাপী বার্থ ডে’ এটুকু বলার সংগে সংগেই বলেন, সেজান কেমন আছো? তৃষ্ণার কি খবর? আমাদের আরও আবাক হবার পালা!
তাঁর মতো মহান শিল্পী প্রত্যেককে নানাভাবে অবাক করবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। বাংলাভাষার নাটকে তাঁর অবস্থান যথার্থই কোথায় তা নির্ধারণ করা হলে আরও অবাক হতে হবে আমাদের। তিনি নাটকের আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন, ধ্রুপদীধারার সঙ্গে আধুনিক অনুসঙ্গ বিনির্মানে কখনও আশ্রয় নিয়েছেন প্রাচীন উপকথার, কখনও জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দর্শনের তত্ত্বজ্ঞানের ভান্ডারকে রুপকাশ্রয়ী করে গেঁথেছেন গল্পের বুনন। তাঁর প্রথমদিকের নাটকে কালমুখীনতা লক্ষ্যনীয় থাকলেও, শেষেরদিকের কাজে কালবিরোধীতার লক্ষন দেখা যায়। এর থেকে অনুমান করি যে তিনি তাঁর নিজের সৃজনশীলতার নিরিক্ষাতেও নাটকের মতই ক্লাইমেক্সের বা চূড়ান্ত পর্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হা হতস্যি, সেই কাজ শেষ হবার আগেই থমকে গেল তাঁর জীবনের ’চাকা’।
আমরা জানি সেলিম আল দীন এক সংগে অনেকগুলো রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ক্রনিক রোগগুলো এরকমই, একটা বাসা বাঁধলে অন্যগুলোও মেহমানের মতো আসে, জুড়ে বসে। তাছাড়া তাঁর মতো নিয়ম-মাফিক-চলা মানুষের মধ্যেও অনেক অনিয়ম জীবনের অনিবার্য সংগী হয়ে ছিল। সৃজনশীল কাজের নিত্য সংগী ’স্ট্রেস’, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্য হূদরোগের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। তাঁর জন্য সেটাই স্বাভাবিক। এও জানি তাঁকে চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন জাগে কেন এই প্রস্তুতি নিতে হয় জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে? কেন বন্ধু-বান্ধব, শিল্পীদেরই প্রিয়জন হারানোরোধে শেষ মুহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে সব জোগার করতে হয়, যখন আর কিছুই করার থাকে না? আমরা কি জাতীয় পর্যায়ে কোন দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না? প্রতিষ্ঠা করতে পারি না কোন ফাউন্ডেশন যা জাতীয় সম্পদের মতো প্রতিভাবানদের অসুস্থতার দূঃসময়ে অর্থ জোগান দেবে? অন্তত পক্ষে ততদিন যতদিন আমাদের নিজের দেশে সুচিকিৎসার সব ব্যবস্থা পর্যাপ্তভাবে থাকছে না। এক্ষেত্রে বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এগিয়ে আসতে পারে। নাকি তারাও ঢাকা থাকবে মাত্রাহীন মুনাফার ঘেরাটোপে?
সেলিম আল দীন চিরকালের মতো চলে গেছেন। সংগে নিয়ে গেছেন বাংলা ভাষায় আরেকটি নোবেল পুরস্কার পাবার সম্ভাবনা। কিম্বা কে জানে তাঁর ওপর গবেষণায় হয়তো দেখা যাবে সে সম্ভাবনার বীজ এখানেই নিহিত আছে। এ আমার আতিশয্য নয়, নির্মোহ ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। শুধু দেখার পালা তাঁর বিশ্বজনীন আবেদনকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিভা কোথায়! ফরাসি-আলজেরিয়ান লেখক, দার্শনিক, নাট্যকার আলবিয়ার কাম্যু’র একবার বলেছিলেন,

"Accept Life, take it as it is? Stupid. The means of doing otherwise? Far from our having to take it, it is life that possesses us, and on occasion shuts our mouths."

জীবনের কাছে আত্নসমর্পন করে জীবনকে মেনে নেয়াই ভালো, নাকি জীবনকে খুঁড়ে নিতে হবে জীবনেরই নির্যাস?, একথার উত্তরও দেবে সেলিম আল দীনের নাটক, এখানেই তাঁর মহৎ কালজয়ীতা।


জানুয়ারি ১৮, ২০০৮ ইউ, এস, এ

*লেখাটি পূর্ব প্রকাশিত


Thursday, June 25, 2009

নিকোসি জনসনঃ জন্মই যার মৃত্যুর তরে দিন গোনার


দক্ষিন আফ্রিকার ডারবান শহরে ১৩তম বিশ্ব এইডস সম্মেলন (World AIDS Congress)অনুষ্ঠিত হলো ২০০০ সালে। এই সম্মেলন নানা কারণে ঐতিহাসিক। এই প্রথমবারের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোগের ওপর এই সম্মেলন। পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ এইচ, আই, ভি এবং এইডস রোগে আক্রান্ত যে মহাদেশে, সেই আফ্রিকায় একত্রিত হলো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সতের হাজার মানূষ। এরমধ্যে পৃথিবীর অন্যতম এইডস গবেষক থেকে শুরু করে, সমাজকর্মী, এজিও প্রতিনিধি, সেক্সওয়ার্কার বা যৌনকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, এইডস রোগী, ঔষধ কোম্পানী, নাট্যদল, সাংবাদিক, সরকারি প্রতিনিধি সকলেই ছিলেন। তাছাড়া এই সম্মেলনের আরেকটি বিশেষ গুরুত্ব একারনে যে ঔষধ কোম্পানিগুলো অত্যন্ত চড়া দামে এইডস এর ঔষধ বাজারজাত করায় পৃথিবীব্যাপী বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের এটাই সূবর্ণ সুযোগ। সবকিছু মিলিয়ে কোটি মানুষের অন্তরে এই সম্মেলন নিয়ে আগ্রহ এবং কৌতুহল।


এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর মানুষ বহু ঘটনা বা তথ্য জানার পাশাপাশি আরেকজন মানুষের কথা জানতে পারলোঃ তার নাম নিকোসি জনসন (Nkosi Johnson)। যে ক্ষুদে মানুষটি আকারে, শারীরিক শক্তিতে দূর্বল হওয়া সত্বেও পৃথিবীব্যাপী সকলেই তাকে এক নতুন অভিধায় অভিষিক্ত করলো, তা হলো ’সুপারম্যান’। ঘরে ঘরে, এইডস রোগের চিকিৎসা কেন্দ্রে, এন জি ও অফিসে, আন্তর্জাতিক সংস্থার কেন্দ্রগুলোতে, দেয়ালে, পোস্টারে ছোটদের সুপার হিরো চরিত্রগুলো যেমন ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের পাশাপাশি নিকোসি জনসনের ছবি টাঙ্ানো হলো। নিকোসি হয়ে উঠলো এইডস রোগীদের সংগ্রামের প্রতিক, দাবি আদায়ের মুখপাত্র। কিন্তু মাত্র এগারো বছরের এই বালকের ইতিহাস নিতান্তই করুণ এবং মর্মস্পর্শী।


নিকোসির জন্ম ১৯৮৯ সালে সাউথ আফৃকায়। নিকোসি পৃথিবীর সেই হতভাগ্য বত্রিশ লাখ শিশুদের একজন যারা হয় জন্ম সূত্রে এই মরণব্যাধির জীবানু এইচ, আই, ভি (HIV) -তে আক্রান্ত হয়েছে, না হয় জন্মানোর পর পরই মাত্র পনের বছর বয়েসের আগেই আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। নিকোসির জন্ম সাউথ আফৃকায়, যেখানে এইডস রোগের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। চৌদ্দ থেকে পঁচিশ বছর বয়েসের প্রতি দুইজনের মধ্যেই একজন এই মরণব্যাধির জীবানুতে আক্রান্ত, প্রতি দশ মিনিটে মৃত্যু হচ্ছে কোন একটি মানুষের, তার মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই সবচাইতে কর্মক্ষম বা সক্ষম বয়সসীমার মধ্যে। পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে যারা নতুন জীবনের পাশাপাশি মায়ের কাছে থেকে পাচ্ছে এইডস রোগের জীবানু। এই শিশুরা নিজের অজান্তেই পৃথিবীর রূপ- রস-গন্ধের স্বাদ পাবার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে তাদের বয়স পাঁচ বছর পৌছুতে না পৌছুতেই। নিকোসি এই হতভাগ্য শিশুদেরই প্রতিনিধি।


দ’হাজার সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে এইচ, আই, ভি আক্রান্ত এবং এইডস রোগীর সংখ্যা ৪২ মিলিয়ন বা চার কোটি বিশ লক্ষ। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এইচ, আই, ভি জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হওয়া মানেই এইডস রোগ নয়। কেউ কেউ এই আক্রান্ত অবস্থায় ছয় থেকে দশ বছর পর্যন্ত কোন রোগের লক্ষণ না নিয়ে থাকতে পারে এবং নিজের অজান্তেই এই রোগের জীবানু ছড়াতে পারে। এই রোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো আফৃকা মহাদেশ। এই ৪২ মিলিয়ন আক্রান্ত লোকের মধ্যে প্রায় ৩০ মিলিয়ন বা তিন কোটি লোকই আফৃকা মহাদেশের, বিশেষ করে সাব-সাহারান আফৃকার। সাউথ আফৃকা এই সাব-সাহারান আফৃকার অর্ন্তভূক্ত। পৃথিবীতে প্রতিদিন ১৪ হাজার লোক নতুন করে এই রোগের জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এর শতকরা ৯৫ভাগই গরিব দেশগুলোর বাসিন্দা। তার মধ্যে দুই হাজার শিশু, বাকি বার হাজার লোক পনের থেকে উনপঞ্চাশ বছর বয়েসের। এই বার হাজার লোকের অর্ধেক নারী, বাকি অর্ধেকের বয়স মাত্র পনের থেকে চব্বিশের মধ্যে। অর্থাৎ পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর সবচাইতে কর্মক্ষম মানুষগুলো এই রোগে আক্রান্ত এবং উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন।


এইচ, আই, ভি-তে আক্রান্ত মায়ের কাছে থেকে শিশুর শরীরে জীবানু সংক্রমনের সম্ভাবনা শতকরা প্রায় ষাট থেকে সত্তরভাগ, বিশেষকরে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে। তার কারণগুলোর মধ্যে প্রসবের সময়ের জটিলতা, রক্তক্ষরণ, জীবানুমুক্ত পরিবেশের অভাব ইত্যাদি। মায়ের কাছে থেকে শিশুর শরীরে এই সংক্রমণের মাত্রা প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব যদি মা কে গর্ভধারণের পরে এ,জী,টি (AZT) নামের একটি ঔষধ দেয়া হয়। যেহেতু এই ঔষধের দাম অত্যন্ত চড়া এবং লম্বা সময় ধরে এটা দেবার দরকার হয়, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জন্য এই চিকিৎসার ব্যয় একেবারেই কল্পণার বাইরে। অথচ এই ঔষধের প্রকৃত দাম বাজার দরের চেয়ে কয়েকশ গুণ কম। ড্রাগ কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য সমস্ত মানবিকতা উপেক্ষা করে মাত্রাছাড়া দাম ধরে রাখার কারণে মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ, জন্ম নিচ্ছে অনেক শিশু এই মরণব্যাধি শরীরে ধারণ করে। শত শত মানুষের আকুতি, মানবধিকার সংগঠনের আবেদন, এইডস সম্পর্কিত নানা ফোরামের বহুবিধ দাবি সত্বেও কোম্পানিগুলোর মন টলেনি। তাই নিজের মাটিতে এই প্রথমবারের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানূষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। এই প্রতিবাদ বিক্ষোভের ভাষা রাজপথে মিছিল থেকে শুরু করে ড্রাগ কোম্পানীর স্টলে কালির আঁচড়ে, বিক্ষুদ্ধ পোস্টারে পর্যন্ত গড়ালো। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিবাদটি করলো মাত্র এগারো বছরের এই বালক নিকোসি জনসন।
তেরতম এইডস সম্মেলনের শ্লোগান ছিল, (Break the Silence) অর্থাৎ ’ভাঙ্গো নিরবতা’। এই শ্লোগানের মর্মার্থ তুলে ধরার জন্য দক্ষিণ আফৃকার আদিবাসীদের বিখ্যাত ’কাওয়াজুলু নাটাল’এর উন্মাতাল ঢোল-মাদলের তালে এক বর্ণিল নৃত্য-গীতময় উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপহার দিলো সাউথ আফৃকা। সাউথ আফৃকার প্রেসিডেন্ট থাবো মেবেকি এবং ইউ, এন, এইডস (UNAIDS) এর নির্বাহী পরিচালক ডক্টর পিটার পিয়ট বক্তব্য রাখলেন। তারপর মঞ্চে এলো এগারো বছরের বালক নিকোসি জনসন। কুচকুচে কালো, রুগ্ন শরীরে কালো রঙের ট্রাউজার, জ্যাকেট পরে বেশ দূর্বল কণ্ঠে নিকোসি জনসন যখন বক্তৃতা শুরু করলো, সারা স্টেডিয়াম জুড়ে তখন পিনপতন নিরবতা। হালকা বৃটিশ উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলছিলো নিকোসি জনসনঃ’জন্মের পরে বাবার নাম জানার আগেই আমি জেনেছিলাম আমার শরীরে এইডস-এর জীবানু আছে। বাবাকে কোনদিন চোখে দেখার সুযোগ হয় নি। তারপর মাকেও হারালাম এইডস রোগে। তবুও আমি এইডস -এ আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান কারণ আমার দত্তকগ্রহীতা মা (ফস্টার মাদার) গেইল জনসন আমাকে মায়ের মতো আদর দিয়েছেন, চিকিৎসা দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন শতশত শিশু এইডস রোগে মার যাচ্ছে। আমাদের বাঁচাতে হলে মাকেও চিকিৎসা দিতে হবে। মা আর শিশুকে আলাদা করা উচিত নয়।
আমাদের এইডস রোগ হলেও আমরা তো সাধারণ আর সব মানুষের মতো। দ্যাখো, আমাদের হাত, পা, চোখ আছে, আমরা তোমাদের মতোই মানুষ।’


নিকোসি জনসনের প্রতিটি কথা যেন মানুষের অন্তরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধছিলো। স্টেডিয়াম ভর্তি অসংখ্য মানুষ, পৃথিবীব্যাপী টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে থাকা বা রেডিওতে কান পেতে শোনা প্রতিটি মানুষের মন বেদনার্ত, নরোম হয়ে গিয়েছিলো তার বক্তব্যে। সম্মেলনে উপস্থিত বড় বড় নেতা, ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিরা মাথা নিচু করে ছিলো লজ্জায়। সভ্য জগতের আয়নার প্রতিবিম্বে যেন প্রশ্নবাণ নিয়ে জেগে উঠছিলো নিকোসি জনসনের রুগ্ন অথচ জ্বলজ্বলে দুটো চোখ, কিসের বড়াই এই সমাজ-সভ্যতার?
তারপর ইউরোপে, আমেরিকায় সর্বত্র আলোচনার ঝড় উঠলো। আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্বব্যাংকসহ বহু সংগঠন চাপ সৃষ্ট করলো ঔষধ কোম্পানীগুলোর ওপর, প্রস্তাব দেয়া হলো সাবসিডির, যাতে ঔষধের দাম কমানো হয়। আগের তুলনায় দাম কমলোও বটে। কিন্তু হায়, এই কম দামের ঔষধ খেয়ে যাবার সৌভাগ্য হলো না নিকোসি জনসনের। ২০০১ সালের জুন মাসে মৃত্যর কোলে ঢলে পরলো সে। তবু নিকোসিই ছিলো সাউথ আফৃকার এইডস আক্রান্ত শিশুদের মধ্য সবচেয়ে দীর্ঘজীবি শিশু।


নিকোসি জনসনের ফস্টার মা, গেইল জনসন নিকোসির ম্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য আর বিশ্বব্যাপী এইডস আক্রান্ত শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যার নাম "Nkoshi's Heaven" ’ বা নিকোসির স্বর্গ। নিকোসির স্বর্গ তখনই সত্যিকারের স্বর্গ হবে যখন পৃথিবীর শিশুরা আর এইডস-এর জীবানু শরীরে নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে না, আক্রান্ত মা পূর্ণ চিকিৎসা পাবে, আর শিশুরা পাবে ঔষধ, আশ্রয়, সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা এবং মানবিক ভালবাসা। মৃত্যুর আগে বহু দেশে গিয়েছিলো নিকোসি জনসন, মানুষকে এইডস বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য। শেষ কথাটি বলেছিলো এভাবে, 'When I grow-up, I would like to lecture more and more people all over the world'’. অর্থাৎ যখন আমি বড় হবো তখন পৃথিবীব্যাপী আরও মানুষের কাছে পৌছে দেব আমার বক্তব্য।


নিকোসি জনসনের সেই ইচ্ছা পূরণের আর সুযোগ হয়নি। কিন্তু তার ইচ্ছেগুলো ছড়িয়ে পরেছে অসংখ্য মানুষের মনে। আমাদের দায়িত্ব নিকোসি জনসনের বক্তব্য পৌছে দেয়ার পৃথিবীর দুয়ারে দুয়ারে। আগামী ২০১০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি শিশু এতিম হয়ে যাবে এই এইডস রোগের কারণে। এই ভয়াবহ অবস্থা প্রতিরোধের এখনই সূবর্ণ সময়। এই দায়িত্ব পালনে আমরা যদি ব্যর্থ হই, নিকোসি জনসনের মতো অসংখ্য শিশুর রুগ্ন অথচ জ্বলজ্বলে চোখগুলো আমাদের তাড়িত করবে সর্বক্ষণ, কিসের বড়াই এই সমাজ-সভ্যতার? আমরা কি পারবো সেই বিবেকের দায় ভাগ এড়াতে?
* সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এ পূর্ব প্রকাশিত

Wednesday, June 24, 2009

সহনশীলতা বনাম আত্নঘাতী উগ্রতাঃ

সাহিত্যে নৈতিকতা বিষয়ে আগের একটি লেখায় 'আমার নাস্তিকানুভূতিতে আঘাত লাগিয়াছে' বাক্যটি সৃষ্টির জন্য অনেক পাঠক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন আমরা কথায় কথায় 'আমার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগিয়াছে' বলি। একথার বিপরীতে এই বাক্যটি অন্য অনুভূতির প্রতি আমাদের মর্যাদাশীল হতে শেখাবে। একদম ঠিক কথা। আমি পাঠকের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু একটা বিনীত অনুরোধ, আমার আলোচনাকে দয়া করে ধর্মের বিরুদ্ধে বা নাস্তিকতার পক্ষে এরকম কোন ছাপ দেয়ার চেষ্টা করবেন না। আমার মূল বক্তব্য হলো প্রতিটি মানুষেরই অধিকার তার পছন্দমতো বিশ্বাসকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার, বা বিশ্বাস না করার। এ দুটোই গ্রহনযোগ্য অবস্থান যতক্ষন না তা মনুষ্যত্ব বা মানবিকতার বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

প্রাবন্দ্ধিক নীরোদচন্দ্র বলেছিলেন আত্নঘাতী বাঙালি। এতে আমরা ক্ষুদ্ধ হয়েছিলাম অনেকেই। কিন্তু একটু গভীরে ভেবে দেখলে আমরা কি অস্বীকার করতে পারি আমরা আত্নঘাতী নই? এই ব্যাপারটিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি। মনোবিজ্ঞানীদের মতে অনেক মানুষের মধ্যে 'সেলফ মিউটিলেটিং বিহেভিয়র' বা নিজেকে শারীরিকভাবে আহত করার প্রবণতা থাকে। এরা নিজেদের শরীর কেটে, বা ক্ষত সৃষ্টি করে আনন্দ পায়, অথবা বুঝতেও পারে না যে কি ক্ষতি করছে নিজের। একজন ব্যক্তির এই বৈশিষ্ঠ্য কি জাতিগত কোন বৈশিষ্ঠ্য হতে পারে? হয়তো পারে না। বা এভাবে কেউ ব্যাখ্যাও করতে চাইবেন না। কিন্তু একটা উদাহরন ধরে নিই। ধরা যাক সরকার দশ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন কোন একটি সেতু বানানোর জন্য। সেখানে যিনি ঠিকাদার তিনি তিন থেকে পাচ শতাংশ লাভ করবেন ধরে নিয়েই বাজেট করা হয়। তারপরও ইঞ্জিনিয়ার, চাদাবাজ, এবং অন্যান্য বখরাবাজদের শেয়ার দিয়ে, ঘুষ, দুর্নীতির গলি-ঘুপচি পার হয়ে নিজের লাভের জন্য ঠিকাদার সাহেব তিনটার বদলে পাচটা বালি মেশাবেন সিমেন্টের সাথে। যে ব্রীজের আয়ু হবার কথা ছিল পনের বছর তা হয়তোবা পাঁচ বছরের মাথায় ভেঙ্গে পরবে। যেমন ভেঙ্গে পরলো সায়দাবাদের ব্রীজ। এভাবে যেদিন ব্রীজটি ভেঙ্গে পরলো, সেদিন হয়তো মারা যাবে নিজের কোন আত্নীয়, ভাই, বোন, শিশু বা অন্য কারো আত্নীয় পরিজন। তাহলে কি নিজেদের তাৎক্ষনিক লাভের জন্য নিজেদেরই বড় ক্ষতি করছি না আমরা? গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে যাদের মধে এই সেলফ মিউটিলেটিং বিহেভিয়র থাকে তাদের মধ্য আত্নহননের বা আত্নঘাতী হবার প্রবনতা বেশী থাকে। তাহলে এই তাৎক্ষনিক লাভ বা ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া কি ঐ সেলফ মিউটিলেটিং বিহেভিয়র-এর সাথে তুলনীয় নয়? এটাই কি আত্নঘাতী রূপ নয়?

সহনশীলতা বা টলারেনস ( এমন একটা বৈশিষ্ট্য যা না থাকলে মানুষকে আর সভ্য বলা যায় না। কোন একটা কিছু নিজের মতের বিরুদ্ধে বা স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই ধর ধর মার মার শব্দে তেড়ে আসেন সবাই। সেই ছাত্রাবস্থায় যখন রাস্তায় শ্লোগান দিতাম 'সন্ত্রাসের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও', তখনই ঘোর আপত্তি করতাম। ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও বলাটাই তো আরেকটা সন্ত্রাস। একটা সন্ত্রাস দিয়ে কি আরেকটা দূর করা যায়? তাছাড়া সমাজের প্রতিটি স্তরে নিজেদের নিয়ে ভয়াবহ হীনমন্যতাবোধ বা ইনসিকিউরিটি। কোন একটা নাটকে হয়তো একজন খারাপ আইনজীবিকে দেখানো হলো, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আইনজীবি সমাজ ক্ষেপে গেলেন, নাট্যকারের ফাঁসি চাই। কিম্বা কোন একটা খারাপ ডাক্তারকে দেখানো হলো, ব্যস, চালাও ধর্মঘট, করো লেখকের মন্ডুপাত। মনিকা আলী ইমিগ্রান্ট বাঙালি স্বামীর এবং অন্যান্যদের অশিক্ষা আর সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরলেন, ক্ষেপে যাও সিলেটবাসী। আমাদের আত্নসম্মানবোধ এতো ঠুনকো কেন? এতো সহজেই টলে যায় কেন সম্মানের হাড়ি?

এই সহনশীলতা বোধকরি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছে গেছে ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে, বিশেষ করে সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে। এখানে অবশ্য বলে রাখছি যে আমি সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বোঝাচ্ছি না। কোন কিছু হলেই অমুকের ফাসি, অমুকের মুখে চুনকালী মাখাতে পারলে পুরস্কার। অমুককে ঘোষনা করো মুরতাদ, অমুসলীম, নিষিদ্ধ করো তাদের প্রকাশনা, রোধ করে দাও বাক স্বাধীনতা। কেউ কেউ যেমন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অতিরিক্ত ভালোবাসায় মনে করে আমি যখন পেলাম না আর কাউকেই পেতে দেবো না তোমাকে, তাই মুখে ছুড়ে মারে এসিড, তাদের মানসিকতার সাথে এই অতিরিক্ত ধর্মপ্রেমের কোন তফাৎ নেই। এই সকল কর্মকান্ডই আত্নঘাতী উগ্রতার সামিল। অথচ ধর্মের সৃষ্টে হয়েছে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ইত্যাদি জাগানোর জন্য।
আমরা পাশ্চাত্যকে যতই দোষারোপ করি না কেন তাদের কাছে থেকে বহু বিষয়ে আমাদের শেখার আছে। তার মধ্যে একটি হলো সহনশীলতা বা টলারেনস। কয়েকটি উদাহরন দেবো যা আমাদেরকে অনেক কিছু শেখাতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব কুইনসল্যান্ডের একজন গবেষক ডঃ রল্যান ম্যাকক্লারি তার থিসিস লিখেছেন যিশু খৃস্টের সেক্সচুয়ালিটি নিয়ে। তার গবেষনা মতে যিশু যেহেতু কখনও বিয়ে করেন নি এবং কোথাও তার কোন নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানা যায় না, নিশ্চয়ই এর বাইরেও অন্য কিছু ছিল। কারণ মানুষ যৌন জীবন বির্বজিত নয়। যদিও কেউ কেউ হয়তো বা পুরোপুরি না হলেও আংশিক যৌন বির্বজিত থাকতে পারেন। ডঃ রল্যান ম্যাকক্লারি তিন বছর ধরে গবেষনার পর বের করেছেন যে যিশু স্বয়ং এবং ন্যুনতমপক্ষে তার তিন জন অনুসারী সমকামী ছিলেন। তার এই গবেষনা বই আকারেও বেরুচ্ছে। এখানে লক্ষ্যনীয় হলো অনেকেই বিশেষ করে খৃশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বীরা তার এই দাবীতে আহত এবং ক্ষুব্ধ, কিন্তু কেউই তাকে মৃত্যু দন্ডাদেশ দেয়নি বা তার মুখে চুন কালি দিতে বলে নি বা তাকে অখৃশ্চিয়ান ঘোষনার দাবি জানায় নি। বরং কেউ কেউ শুধু মন্তব্য করেছেন এই বলেঃ What a joke! Tell the guy to go on big brother, if he wants attention that bad!, অর্থাৎ কি তামাশা! লোকটাকে বলো চালিয়ে যেতে ওর যদি এতই মনোযোগ পাওয়ার খায়েস! পাশাপাশি ড্যান ব্রাউন বই লিখেছেন রহস্য উদঘাটনের আঙ্গিকে 'দা দ্য ভিঞ্চি কোড' নামে যেখানে যিশুকে তারই একজন অনুসারী মেরী ম্যাগডালেন সঙ্গে বিবাহিত দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে দ্য ভিঞ্চির আকা ছবিকে একটা ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ যিশুর সমকামীতার দাবীকে ঠেকানোর জন্য ইতিহাসের ভান্ডার থেকে উপাদান নিয়ে পালটা লিখে তার জবাব প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস। প্রিয় পাঠক আপনারাই অনুমান করুন, এই ঘটনা যদি আজকে হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের কোন ধর্মগুরু কে নিয়ে হতো তাহলে কি ঘটতো! আমাকে তা পুনরুল্ল্যেখ করার প্রয়োজন নেই।এখানেই শেষ নয়। যে খৃশ্চিয়ান ধর্মে সমকামীতাকে একেবারে গ্রহন করা হয়না। এই প্রথমবারের মতো জেন রবিনসন যিনি একজন প্রকাশ্য সমকামী তাকে নিউ হ্যাম্পসায়ার-এর একটি গীর্জায় ধর্ম যাজকের পদে নিয়োগ করা হয়েছে। এই উদাহরনগুলো একারনে দিচ্ছি না যে আমি খৃশ্চিয়ান ধর্মের বা খৃশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বীদের গুণগ্রাহী। এই উদাহরন গুলো দেয়ার উদ্দেশ্য হলো অন্যদের কাছে থেকে যে আমাদের সহনশীলতা শেখা উচিত তা অনুধাবনের জন্য।
আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে ভুরি ভুরি ঘটনা দেখতে পাবো যেখানে সত্য আবিস্কারের জন্য বা সত্য কথা বলার জন্য অনেক ঙ্গানী ব্যক্তিদের নিগৃত করা হয়েছে, এমন কি হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। যেমন, যখন চিকিৎসক ইবনে সিনা মানুষের শরীর কেটে হার্টের সার্জারি করতে চেষ্টা করেছিলেন তখন তার শহরের লোকেরাই তাকে বিতারিত করেছিল নিজ এলাকা থেকে ধর্মের অজুহাতে। যখন আন্দ্রিয়াস ভিসালিয়াস মানব শরীরের ওপর প্রথম বই 'দ্য হিউমানি করপোরি ফেব্রিকা' লেখার জন্য মানুষের মৃতদেহ জোগার করতে গিয়েছিলেন তখন ধর্মগুরুরা তাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করে এবং তিনি পালিয়ে প্রাণে না বাচলে আজকের এই আধুনিক শরীরবিদ্যার হয়তো জন্মই হতো না। রসায়নবিদ লাভয়সিয়ে যখন বাতাসে অক্সিজেনের উপস্থিতি এবং এটার গুনাগুন আবিস্কার করেন এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রভাবের পক্ষে কথা বলেছিলেন তখন গীর্জার ধর্ম পন্ডিতেরা, ধর্মান্দ্ধ রাজনীতিকেরা তাকে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণের অজুহাতে গিলোটিনে (গলা কেটে) হত্যা করেছিল। তার হত্যা দেখে আরেকজন পন্ডিত জোসেফ লুই ল্যাগ্রাঞ্জে বলেছিলেন, ‘It took them only an instant to cut off that head, and a hundred years may not produce another like it.‘ অর্থাৎ এই মাথাটি কাটতে ওদের মাত্র এক পলক লেগেছে, অথচ একশ বছরেও হয়তো এমন একটি মাথার জন্ম হবে না।

শুরুতেই সহনশীলতা এবং আত্নঘাতী উগ্রতার কথা বলেছিলাম। আমাদের দেশের ধর্মান্দ্ধ, ফতোয়াবাজদের ইতিহাসের এই সব ঘটনার দিকে তাকাতে বলি। এই উগ্রতা আত্নঘাতী তার কারণ পৃথিবীর ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। যা কিছু সভ্যতার সামনে নিয়ে এসেছে পশ্চাদপদতার অন্দ্ধগলি, সে সব কিছুই নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। এখানেই মানুষের ঐতিহাসিক জয়। এই আত্নঘাতী পথের তখনই শেষ হবে যখন সহনশীলতার মতো মানবিক গুন অর্জিত হবে, অর্জিত হবে সত্যিকারের মুক্তমন। একারনেই বুঝি দার্শিনিকেরা বলেছিলেন, মুক্তমনের চেয়ে বড় কোন সম্পদ নেই!

* সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ পূর্বপ্রকাশিত

Monday, June 22, 2009

নেলসন ম্যান্ডেলার দেহরক্ষী প্রধান : এক চমকপ্রদ ভালোবাসার গল্প

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে পৃথিবীর আরো অনেকের মতো আমারও এক ধরনের ’অবসেশন’ আছে। এই অসাধারণ মানুষটির আত্নত্যাগ, নেতৃত্ব আমাকে শুধু মুগ্ধই করেনা, জীবনের অনেক ক্ষেত্রে প্রেরনাও জোগায়। ১৯১৮ সালের জুলাই মাসে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম এমন এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে, যেখানে নিজ দেশে কালো মানুষেরা ক্রীতদাসের মতো নিগৃত, অত্যাচারিত ছিল। স্কুল বয়সেই ছাত্র-নেতৃত্বে অংশগ্রহনের দায়ে বরখাস্ত হন তিনি। তারপর থেকে ক্রমাগত সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে দক্ষিণ আফ্রিরার মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় নেতা, তথা সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় নেতায় পরিনত হন তিনি। ১৯৬২ সালে বর্ণবাদী শাদাদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার বিনাঅনুমতিতে দেশ ত্যাগের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করে। সেই মামলায় নিজের পক্ষে নিজেই আইনজীবীর ভূমিকা পালন করেন নেলসেন ম্যান্ডেলা। প্রহসনের সেই মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে কালো মানুষদের মুক্তির আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বর্ণবাদী শাষকেরা। দীর্ঘ প্রায় আটাশ বছর কারাবন্দী ছিলেন তিনি। বহুবার নানা শর্ত দিয়ে মুক্তির লোভ দেখিয়েছে শাষকের দল। নিজের অপরিসীম দূর্ভোগের মধ্যেও মাথা নত করেন নি তিনি, বরং বিপ্লবী স্পর্ধায় উত্তরে বলেছেন অসাধারণ সেই উক্তিঃ "ওনলি আ ফ্রি ম্যান ক্যান নেগোশিয়েট"।
১৯৮৮ সাল। সারা পৃথিবীব্যাপী নেলসন ম্যান্ডেলার সত্তরতম জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ চলছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আমি তখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সারাদেশ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে এক লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহের এক আন্দোলনের সংগে আমিও জড়িয়ে গেলাম। এই উপলক্ষে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। আমার ইচ্ছা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে লেখা কোন গান শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো। কিন্তু কোথাও কোন গান খুঁজে না পেয়ে নিজেই দুটো গান লিখে ফেললাম। তখন আমি সবে মাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে গান লেখা শুরু করেছি। সেই সূত্র ধরে বেশ কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর সংগে আমার পরিচয় হয়েছে। সামিনা চৌধুরী আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন এবং ভালো বন্ধুও বটে। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে গাইবার সম্মতি দিলেন। সামিনার গাওয়া ’নেলসন ম্যান্ডেলা, তুমি সবল দুটি হাতে লোহার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছো’ সেই গানটির সুর করলেন নকিব খান। দ্বিতীয় গানটি গাইবার জন্য বললাম গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর কে। তিনিও এক কথায় রাজী হলেন। কিন্তু তার জন্য লেখা ’কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটির তখনও সুর দেয়া হয়নি, এদিকে সময়ও কম। আমি নিজেই গানটিতে সুর দিয়ে পৌছে দিলাম তার কাছে। সেদিন মিটফোর্ডের হল ভর্তি মানুষকে মুগ্ধ করলেন এই শিল্পীদ্বয়, নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবীতে সংগৃহীত হলো অসংখ্য স্বাক্ষর। সামিনা যদিও তার গান টি আর অন্য কোন মাধ্যমে গাননি, কিন্তু ফকির আলমগীর মিটফোর্ডের গন্ডি পেরিয়ে বাংলা একাডেমী বই মেলা, জনতার মঞ্চ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে পৌছে দিলেন গান টিকে। এমন কি গানটির একটি ক্যাসেট খোদ নেলসন ম্যান্ডেলাকেও পৌছে দেয়া হয়েছিল।
সেই নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ দক্ষিন আফ্রিকা যাবার সুযোগ এলো এই ঘটনার ঠিক বার বছর পর, ২০০০ সালে। দক্ষিন আফ্রিকার ডারবান শহরে বিশ্ব এইডস সম্মেলনে আমার গবেষণাপত্র উপস্থাপনের আমন্ত্রণ এলো। এই আমন্ত্রণ আমার জন্য ত্রিমুখী আনন্দের উৎস বলা যেতে পারে। প্রথমতঃ এই এইডস সম্মেলনের সমাপ্তিদিনে প্রধান অতিথি স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলা, তাঁকে কাছে থেকে দেখবার সূবর্ণ সুযোগ। দ্বিতীয়তঃ আমেরিকার একটি স্টেস্ট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার চাকরি গ্রহনের পর এটাই আমার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাওয়া। তৃতীয়তঃ আমার স্ত্রী যিনি পেশায় চিকিৎসক এবং নেশায় নাট্যকর্মী, চাকরির কারণে প্রায় দেড় বছর পরষ্পর থেকে বিচ্ছিন্ন, সে-ও বাংলাদেশ থেকে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপনের জন্য ইউ এন ডি পি'র স্কলারশীপ নিয়ে এই সম্মেলনে আসবে। যেহেতু এই সম্মেলনের বিশেষ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে আলাদা লেখার ইচ্ছে আছে তাই শুধু নেলসন ম্যান্ডেলার দেহরক্ষী প্রাধানের বিষয়টিতেই কেন্দ্রীভূত থাকবো।
ভারত মহাসাগরের তীর ঘেষা অপূর্ব সুন্দর শহর ডারবান। মাত্র কয়েক বছর আগেও এখানে শাদাদের অত্যাচারে শৃঙ্খলিত কালো মানুষের আর্তনাদ শোনা যেতো, মুখ থুবরে পরে থাকতো মানবিক মূল্যবোধ। আজ সেখানে কালো মানুষেরা ক্ষমতার শীর্ষে। নেলসন ম্যান্ডেলা যদিও এখন আর প্রেসিডেন্ট পদে নেই, কিন্তু এখনও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে সন্মানিত এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। এই ডারবান শহরে সারা পৃথিবী থেকে সতের হাজার লোক একত্রিত হয়েছে এইডস সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য। এক অভূতপূর্ব মিলন ক্ষেত্রে পরিনত হলো এই ডারবান শহর। একদিন আমার এক অনুজপ্রতিম ডাঃ মুনির হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানালো সম্মেলনের কাছেই এক হোটেল কক্ষে নেলসন ম্যান্ডেলার সাংবাদিক সম্মেলন হবে। দু’জনেই ছুটে গেলাম সেই হোটেলের কাছে। গিয়ে জানতে পারলাম এক অঙ্গাত কারনে সাংবাদিক সম্মেলন বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এইডস সম্মেলনের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কখন নেলসন ম্যান্ডেলার সংগে দেখা হবে বা হতে পারে। একদিন লক্ষ্য করলাম দু’জন স্যুট কোট পরা কেতাদূরস্ত ভদ্রলোক সম্মেলন কেদ্রের আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে। তাদের পেটানো শরীর, চোখের সার্বক্ষণিক সান গ্লাস, কানের পাশে প্যাচানো তার থেকেই বুঝতে পারি এরা সিকিউরিটির লোক। এদের মধ্যে একজন কালো। আমি তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করি। সে জানায় যে সম্মেলনের সমাপনীদিনের জন্য আগাম সিকিউরিটি চেক করছে তারা। আমি একথায় সেকথায় নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে আমার গান লেখার কথা বলি, ভদ্রলোকও উৎসাহের সঙ্গে আমার সাথে আলাপ করেন। এক সময় বলেন "ইউ লুক লাইক আ জার্নালিস্ট, আর ইউ লুকিং ফর স্টোরিজ?". আমিও সহাস্যে সম্মতির মাথা নাড়ি। তিনি বলেন ’তুমি কি ররি স্টেইন এর নামে শুনেছো’? বললাম ’না’। তারপর তিনি ররি স্টেইন এর গল্প বললেনঃ
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ররি স্টেইন শাদা পুলিশ বাহিনীর ইন্টেলিজেনস ব্রাঞ্চ এবং 'বোম্ব ডিস্পোজাল' শাখার একজন সদস্য ছিলো। গণ আন্দোলনের বিজয়ের পর নেলসন ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন, ১৯৯৬ সালে ররি স্টেইন তখন নিযুক্ত হন নেলসন মেন্ডেলার দেহরক্ষী বাহিনী ’প্রেসিডেনশিয়াল প্রোটেকশন ইউনিট’ -এর প্রধাণ হিসেবে। নিযুক্তির অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নেলসন মেন্ডেলার কাছে একটি গোপন ফাইল আসে, তাতে লেখা এই ররি স্টেইন শুধু শাদা বাহিনীর সাধারণ পুলিশ অফিসারই ছিলো না, নেলসন ম্যান্ডেলার সমর্থক 'সাউথ আফ্রিকান কাউন্সিল অব চার্চেস' এর হেডকোর্য়ারটার 'খোস্টো হাউস'-এ ৮৮ সালে বোমা হামলার সংগেও জড়িত ছিলো। শুধু তাই নয়, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অনেক নেতা কর্মীদের নির্যাতনের সাথেও সে জড়িত ছিলো। একথা শোনার পর স্বয়ং ররি মনে করেছিলো যে তাকে আর নেলসন মেন্ডেলার দেহরক্ষী বাহিনীতে রাখা তো হবেই না, উপরন্তু তাকে শাস্তি দেয়া হতে পারে। একদিন নেলসন মেন্ডেলার কক্ষে ডাক পড়লো। ররি ভাবলো এই বুঝি বিদায় ঘন্টা বেজে উঠলো। কিন্তু বাস্তবে হলো অন্য রকম। নেলসন ম্যান্ডেলা তাকে ডেকে ’স্পিরিট অব নিউ সাউথ আফ্রিকা ’-র কথা বললেন। তাঁর মহানুভবতায় ররির মাথা নুয়ে আসে। তার ভাষায়, ‘আই উড, ইফ নেসেসারি, লে ডাউন মাই লাইফ ফর দিস ম্যান’. অর্থাৎ প্রয়োজন হলে এই মানুষটির জন্য প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হবো না। এক সময়ের রেসিস্ট ররি স্টেইন শেষ সময় পর্যন্ত নেলসন মেন্ডেলার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসেবে কাজ করে গেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ররি তার এই কাহিনী লিপিবব্ধ করেছেন সাউথ আফ্রিকার একজন সাংবাদিকের কলমে, যার একটি কপিও সংগ্রহ করার হদিস পেলাম এই সিকিউরিটি অফিসারের কাছে। এভাবে মানুষের মন জয় করার কারণে নেলসন মেন্ডেলাকে স্থানীয় অধিবাসীরা বলতো ‘মাডিবা ম্যান্ডেলা’। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একবার নেলসন মেন্ডেলাকে বামঘেঁষা দেশগুলোর সঙ্গে বেশী বন্ধুত্বের জন্য অভিযোগ করেছিলেন। জবাবে নেলসন মেন্ডেলা বলেছিলেন ’যখন আমরা বুটের নিচে নির্যাতিত হচ্ছিলাম, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? আমরা তো পুরনো বন্ধুদের ভুলতে পারি না’। একথার পর আমেরিকার দৈনিকগুলোতে খবর ছাপা হয়েছিল এই বলে যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর একথা বলার সাহস পৃথিবীর একজন নেতারই আছে তিনি নেলসন মেন্ডেলা। অথচ এবছর নেলসন মেন্ডেলা যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য রাখার পর আমেরিকার কোন একজন পদস্থ ব্যক্তি বলেছিলেন 'হু ইজ ম্যান্ডেলা?’. কে বলেছিলো এই কথা, আমি আমেরিকায় বাস করেও মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করিনি। অথচ নেলসন মেন্ডেলার কথা মনে থাকবে আজীবন, এখানেই তাঁর সাফল্য। নেলসন মেন্ডেলাকে নিয়ে লেখা আমার পুরো গানটির কথা তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি নাঃ
‘কালো কালো মানুষের দেশে, ঐ কালো মাটিতে
রক্তের স্রোতের সামিল
নেলসন মেন্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্তমিল
তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল
অগুন্তি মানুষের হূদয়ের মিল।।

শৃঙ্খল শিখিয়েছে শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিতে আজ
রক্তের উষ্ণতা, মুক্তির মন্ত্রনা বিপ্লবী শ্রমিকের হাতুরির দৃঢ় কারুকাজ
কারাগার ভেঙ্গে আসে প্রতিবাদী এক গাংচিল।।

মৃত্যুর দরজায় করাঘাত করে আসে যুদ্ধ
বিপ্লব আসবেই আফ্রিকা হাসবেই, অগনিত কালো হাত পৃথিবীকে করবেই শুদ্ধ
মেঘের আকাশ হবে পতাকায় শোভিত সুনীল।।
শুভ হোক তোমার জন্ম দিনশুভ হোক তোমার মুক্তির দিন।।

এই গানের অনেক কিছুই সত্যি হয়েছে। এই গান লেখার দু'বছর পরেই নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পেয়েছিলেন কারাগার থেকে, আফ্রিকা হয়েছে শৃঙ্খলমুক্ত। এ গানের প্রতিটি অক্ষরই সত্যি হোক, পৃথিবী হোক শুদ্ধ, শোভিত সুনীল।
*সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এ পূর্বপ্রকাশিত

দুই বাংলার কবিতা সম্মেলনঃ অন্তর দুইভাগ হবার যন্ত্রণা


কোলকাতা নিয়ে আমার স্বপ্নচারিতা সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা মাঝে মাঝেই কোলকাতা যেতেন আর বড় ভাই-বোনদের দেখতাম কোলকাতার মাস্টার কোম্পানীর ইংলিশ প্যান্ট অথবা কোট পরতে। আমার ভাগ্যে তা কখনও জোটে নি। আমি ছিলাম ছ’ ভাই-বোনের মাঝে সবার ছোট। সোনার চামচ, রূপার চামচ ছাড়িয়ে আমার ভাগ্যে কাঠের চামচের মতো আবস্থা। বাবার কাছে মাঝে মাঝে কোলোকাতার গল্প শুনতাম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবীন্দ্রসদন, রেলওয়ে ইত্যাদি। তাছাড়া গল্প-উপন্যাস পড়ে পড়ে মনের মধ্যে কোলকাতা নিয়ে একটা আলাদা জগৎ, আলাদা স্বপ্নচারিতা। তাই যখন প্রথম কোলকাতা যাবার সুযোগ এলো আমার মনে তখন অন্যরকম আনন্দের দোলদুলুনি।
৯১’এর একুশের বই মেলায় আমার কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে একটি ছিলো ’অপারেশন জ্যাকপট’। মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার অকথিত গল্প নিয়ে এই বই। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের তুলন শহরে একটি পাকিস্তানি সাবমেরিনে ট্রেনিং-এ ছিলেন ১৩জন বাঙালি সাবমেরিনার। তাদের মধ্যে থেকে ৯ জন একটি সাবমেরিনসহ পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। সেই নয়জনের একজন ধরা পড়েন পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের হাতে এবং নিখোঁজ হয়ে যান। বাকি আটজন পালিয়ে এসে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় গড়ে তোলেন একটি গোপন সুইসাইড বাহিনী। যারা একসংগে চিটাগাং, মোংলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে আক্রমণ করে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করেন। এই নৌ-কমান্ডোদের অসাধারণ আত্নত্যাগের কাহিনী বিস্তারিত লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রায় দুবছর কাজের ফসল ’অপারেশন জ্যাকপট। ’অপারেশন জ্যাকপট’ ছিলো এই কমান্ডো আক্রমনের সাংকেতিক নাম। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের এই অধ্যায়টি বিস্তারিতভাবে বাংলাদেশের কোথাও লেখা ছিলো না, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ষোল খন্ডের দলিলপত্রেও ভাসা ভাসা কয়েকটি সাক্ষাৎকার ছাড়া আর কোন বিবরণ নেই, আমি চিটাগাং পর্বটি নিয়ে প্রথম বইটি প্রকাশ করেছিলাম। এই বইয়ের ঘটনাটি বিস্তারিত লেখার উদ্দেশ্য হলো এর সংগে আমার কোলকাতা যাবার যোগসূত্র আছে।
অপারেশন জ্যাকপট-এর প্রথম পর্বটি সুধীমহলে ভালোভাবেই গৃহীত হলো। ডঃ হায়াৎ মামুদ লিখলেন বিচিত্রায়, মফিদুল হক লিখলেন আজকের কাগজের উপসম্পাদকীয়। তবে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন এরকম একটি প্রামান্যগ্রন্থকে আমি কেন কিশোর গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। উত্তরে হাসতে হাসতে বলতাম, ’যেহেতু বড়দের মস্তিস্ক ইতোমধ্যেই পচে গেছে, তাই তাদেরকে উদ্দেশ করে লেখার আর দরকার নেই, একমাত্র কিশোরেরাই পারবে নতুন কিছু করতে, নতুন পরিবর্তন আনতে’। যাহোক, অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে সবচেয়ে সুখকর ছিলো শওকত ওসমানের একটি ব্যক্তিগত চিঠি। ৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পনের তারিখে লেখা সেই চিঠির একটি অংশ তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখেছেনঃ ‘নাস্তি অপেক্ষা বিলম্ব শ্রেয়তর .....জাতীয় বড় দুঃসময়ে অনাবিস্কৃত আর এক জগত তুমি উন্মোচন করেছো দেশবাসীর সন্মুখে । নৌযুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামের এক দিক। কিন্তু তা স্পষ্ট কারো কাছে নয়, আমার কাছেও ছিলো না- বলতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। মুক্তিসংগ্রামের চেতনা যখন নানাভাবে মুছে দেয়ার চেষ্টা, তখন তোমার এই পুস্তকরূপী সাইরেন অনেককে দিশার পথ দেখাবে। .....অপারেশন জ্যাকপট-এর প্রচার বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন।’
দেশের অন্যতম প্রধান লেখকের কাছে থেকে এই আশীর্বাদ আমার কাছে তখন অসাধারণ প্রেরণার সামিল। আমি অপারেশন জ্যাকপটের চার পর্ব লিখবো বলে স্থির করলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম ইন্ডিয়ার ’ফোর্ট উইলিয়াম’ সামরিক কেন্দ্রে এই ঘটনার দলিলপত্র আর্কাইভ করা আছে। তাছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে এই ঘটনার কিঞ্চিৎ আভাস দিয়েছিলেন, তাকেও জিঙ্গেস করতে চাই কোন খোঁজ খবর বা দলিলপত্র দিতে পারেন কিনা। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মফিদুল হক আমার একনিষ্ঠ উৎসাহদাতা। তিনি আগাম সম্মানীর নাম করে টাকা দিলেন কিছু। তিনি জানেন আমি নিতান্তই ছাত্র, তাকে কখনও কিছু খুলে বলতে হয়না, ভীষণ সহমর্মিতায় বুঝে নেন সব। তার প্রকাশনী সংস্থা থেকে ’বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ অভিযাত্রী’ শিরোনামে আমার আরেকটি বই বেরুবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই বইতে বিশ্বের দশজন শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রীর কথা বলা হবে যাদের মধ্যে একজন থাকতে হবে বাঙালি। বাঙালি অভিযাত্রী খুঁজতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত যাকে পেলাম তিনি হলেন রামনাথ বিশ্বাস। সত্তর বছর আগে যিনি বাই সাইকেল চড়ে বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু রামনাথের ওপর কোন তথ্য বাংলাদেশের কোথাও পেলাম না। জানলাম কোলকাতার কোথাও তার ওপর তথ্য পাওয়া যেতে পারে। ঠিক হলো এই দুই কাজ নিয়ে কোলকাতা যাব। ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে ভিসা নিতে গিয়ে কবি বেলাল চৌধুরীর সংগে দেখা। তিনি বললেন,আরে ভাল সময়ে কোলকাতা যাচ্ছো। ওখানে দুই বাংলার কবিতা সম্মেলন হবে। তুমি থাকবে আমাদের সংগে ছড়াকার হিসেবে। আমি বললাম,আমি তো আমন্ত্রিত নই, আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?তিনি আমার কথা নাকচ করে দিয়ে বললেন, বাংলাদেশের কবিদের দলে একজন ছড়াকার থাকার কথা, তুমি কনিষ্ঠতম বয়সে ছড়া সাহিত্যে শিশু একাডেমী পুরস্কার পেয়েছো, তুমি যাবে নাতো কে যাবে, হাঁ?আমি প্রচন্ড আনন্দের সংগে সায় দিলাম। এসব ঘটনা তখন আমার মনের মধ্যে তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি করেছে। আমি সমেশপুর নামের এক অখ্যাত গ্রামের ছেলে। সেখানে বসে যতই রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, তলস্তয়, কাম্যু বা কাফকা পড়ি না কেন দেশের এই স্বনামখ্যাত লেখক, কবিদের সাহচর্য আমার কাছে দূর্লভ প্রাপ্তির মতো। তাদের কাছে আমার প্রবেশাধিকার প্রতিনিয়ত অবাধ ও অবারিত হচ্ছে এই ভেবেই আমি অসম্ভব আনন্দ অনুভব করি। আমি কোলকাতা যাবার উত্তেজনায় রীতিমতো স্যুট, কোট পরে বাংলাদেশ বিমান বন্দরে হাজির হলাম।
’আবৃত্তিলোক’ নামের একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে দুই বাংলার কবিতা সম্মেলন হচ্ছে। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। এরমধ্যে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসেইন, আবৃত্তিকার ক্যামেলিয়া মুস্তাফা, মারিয়ম মান্নান এসে অপেক্ষা করছেন লাউঞ্জে। বেলাল চৌধুরী হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এই কবি দলের সংগে তসলিমা নাসরিনের যাবার কথা। এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন তার পাসপোর্ট আটক করেছে। ফর্সা, সুদর্শন বেলাল চৌধুরী রাগে লাল হয়ে ফোন করলেন কবি ইমরান নূর কে। কবি ইমরান নূর পেশায় বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট এর সচিব। তিনি জানালেন সরকারের উঁচু মহল থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাই কিছু করার নেই। সবাই এই ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করায় মন দিলেন। রফিক আজাদ বললেন, চলো ডিউটি ফ্রী শপ থেকে পছন্দের ’ড্রাই জিন’ কেনা যাক।
বিমান ছাড়লো ঢাকা এয়ারপোর্ট। বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই এটাই আমার প্রথম প্লেনে চড়া। ভেতরের ছটফটানি কাটিয়ে এয়ার হোস্টেজের দেয়া নাস্তার প্যাকেট শেষ করতে না করতেই ঘোষনা দেয়া হলো আমরা কোলকাতা পৌছে গেছি। আমি এতো নিরাশ আর কখনও হই নি। দম দম এয়ারপোর্টে পৌছে আমার আরও করুন অবস্থা; আমার মতো জবরজং পোশাকে আর কেউ নেই। আমি কেন যে কোলকাতা নিয়ে অন্যরকম একটা ধারণা করেছিলাম তা ভেবে বেশ বোকা বোকা লাগছিল নিজেকে। তাছাড়া প্রচন্ড গরম। আমি তাড়াতাড়ি কোট টাই খুলে ব্যাগে ভরলাম। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পুরো দলের রাজসিক ওয়েলকামের ভাগ আমিও পেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে কোলকাতা শহর প্রায় এক ঘন্টার ট্যাক্সি-পথ। এই এক ঘন্টা মনে হলো কয়েক যুগের সমান। তার কারণ দম দম এয়ারপোর্টের কাছে শহরের আবর্জনা ফেলার বিরাট ডাস্টবিন। সারাপথ ’এই দম বন্ধ, তারপর জীবন বাঁচাতে শ্বাস গ্রহন’ করতে করতে শহরে একটা রেস্ট হাউসে এসে উঠলাম। আমি বললাম, ’দম দমে এসে যদি দমই না নেয়া গেল, তাহলে তো বিপদ’। সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠলেন। কিন্তু আয়োজকেরা মনে হলো খুশি হলেন না। একটা বড় কনফারেনস রুমে সবাই অপেক্ষা করছি, বড় টেবিলের ওপরে রফিক আজাদের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে আনা কেনাকাটার ব্যাগটা রাখা। কেউ একজন হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন সেই ব্যাগ। ব্যাগে ছিলো সদ্য কেনা ড্রাই জিনের বোতল। মাটিতে পরেই ভাঙলো সেটা। রফিক আজাদ রেগে বোম, অনেকটা ’ভাত দে নইলে মানচিত্র খাবো’র বদলে ’ড্রাই জিন দে নইলে বাংলা খাবো’র মতো অবস্থা।
আমার গোড়া থেকেই নিজেকে অনাহূত মনে হচ্ছিলো। তাছাড়া আমার নিজের কাজের বিষয়গুলোও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই সুস্বাদু মাছ-ভাত-সব্জি দিয়ে খাবার সেরে আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম কোলকাতা নিউমার্কেটের কাছে ’ক্যাপিটাল রেস্ট হাউসে’। এখানে আমার নামে আগেই ঘর রিজার্ভ করে রেখেছেন পুস্তক প্রকাশক ও পরিবেশক পার্থ দা। আমি আমার কাজগুলোকে ভাগ করলাম দু’ভাগে; অপারেশন জ্যাকপট সংক্রান্ত যোগাযোগ এবং রামনাথ বিশ্বাসের ওপর তথ্য সংগ্রহ। জ্যাকপটের কাজের জন্য মূলত যোগাযোগ করবো তিন জনের সংগে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিধান রায়ের ছেলে রঞ্জন রায় এবং ’প্রতিক্ষণ’ প্রত্রিকার সম্পাদিকা স্বপ্না দেব। স্বপ্না দেব আমাকে রামনাথ বিশ্বাসের ওপর কিছু দূর্লভ বইয়ের সন্ধানও দেবেন। নিউ মার্কেট থেকে প্রতিক্ষণের অফিস বেশি দূরে নয়। অফিস বিলডিংটা পুরনো দিনের কোলকাতার আমেজ ধরে রেখেছে। আমি পৌছে নিজের পরিচয় দিলাম ’অফিস বয়ে’র কাছে। সোজা সম্পাদিকা স্বপ্না দেবের ঘরে ডাক পরলো। তিনি জানেন আমার আসার উদ্দেশ্য। স্বপ্না দেব মধ্যবয়সী, সুন্দরী, ব্যক্তিত্বপূর্ণ একজন মহিলা। আমি সদ্য মেডিকেল কলেজের গন্ডি পার হবার পথে। অপারেশন জ্যাকপটের কাজে এসেছি শুনলে সবাই ধারণা করেন একজন বয়স্ক লোককে, আমার মতো চ্যাংড়া কাউকে না। যা হোক, স্বপ্না দেবের রুমেই পরিচয় হলো অরুণ রায়, প্রিয়ব্রত রায়ের সংগে। এরা সবাই প্রতিক্ষণের সংগে দীর্ঘ দিন থেকে জড়িত। আমার কথাবার্তায় যথেষ্ঠ ঢাকা, সিরাজগঞ্জের টান এসে যায়। সেই টানের খেই ধারে স্বপ্না দেব বললেন,’তোমাকে তো মুড়ি-পিয়াজি খাওয়াতে হবে। ওহ , তুমি ঢাকার ছেলে, তোমরা তো আবার পিয়াজি বলো না, বলো পিয়াজু।’আমি ঠাট্টার ভংগিতে বললাম,’হ্যা, আপনারা জ্বী হুজুর! জ্বী হুজুর ! করতে করতে অভ্যাসটা সব জায়গাতেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের লোকেরা সংগ্রাম করতে করতে আর ’জ্বী বলতে পারে না, বলে ’জু‘।সবাই হেসে উঠলো। স্বপ্না দেব একগাদা মানুষের নাম, ফোন নাম্বার দিয়ে দিলেন। তাতে পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের লাইব্রেরিয়ান পর্যন্ত আছেন। বললেন, বইমেলায় প্রতিক্ষণের স্টলে এসো, আর যা দরকার হয় জানিও আমাকে। আমার কপাল ভাল, কোলকাতা বইমেলা হচ্ছে ঠিক একই সময়ে। মনে মনে ভাবলাম এখানে এসে পিয়াজু-মুড়ি খেতেই হবে। তারপর বের হলাম লিস্ট ধরে লোক খোঁজার ধান্ধায়।
আবৃত্তিলোকের প্রথম দিনের কবিতা সম্মেলন বেশ জমে উঠলো। পত্র-পত্রিকায় এটার ওপর আলোচনা। তবে ঐ সময়ে ’হেডলাইন’ নিচ্ছে তোলপার করা সব রাজনৈতিক ইস্যু। বাবরি মসজিদের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা চলছে চারিদিকে। আনন্দবাজার পত্রিকা তসলিমা নাসরিনের পাসপোর্ট আটক করা নিয়ে লিখছে। এই কবিতা সম্মেলন খুব মিডিয়া কাভারেজ না পেলেও একেবারে কমও আলোচনা হচ্ছিলো না। সৈয়দ শামসুল হকের প্রবন্ধ নিয়ে বেশ হইচই হলো। পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি-সমালোচক মন্তব্য করলেন যে বাংলাদেশের কবিতায় খুব বেশি শ্লোগান থাকে, অনেক সময় শিল্পগুণ রক্ষা হয় না। এগুলো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতের্কর বহু বোদ্ধাজন উÌস্থিত ওখানে, আমি রীতিমতো উপভোগ করি এই সুমধুর লড়াই আর নিজের কাজের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াই।এই সম্মেলনেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে পেলাম। অপারেশন জ্যাকপটের একটা কপি দিয়ে বললাম, এ বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই। তিনি আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে আসতে বললেন।
কবিতা সম্মেলনের দ্বিতীয়দিন বিকেলে ছড়া পাঠের আসর। বেলাল চৌধুরী বার বার বললেন যেন কোনভাবেই ’মিস’ না করি। তাছাড়া ছড়া পাঠের আসরে সভাপতিত্ব করবেন অন্নদা শঙ্কর রায়। তাঁর সঙ্গে দেখা করা এবং পাশে বসে ছড়া পাঠের সৌভাগ্য শুধু আমার কাছে কেন, যে কোন ছড়া-প্রেমীর জন্য রীতিমতো দূর্লভ বিষয়। মঞ্চের কাছে গিয়ে শুনলাম অন্নদা শঙ্কর রায় খুব অসুস্থ। আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি সরল দে। তিনিও প্রবীন অতি নমস্য ব্যক্তি। মঞ্চে ফরাস পাতা, তাতে একে একে পশ্চিম বাংলার ছড়াকারেরা এসে বসলেন। বাংলাদেশ থেকে আমিই একমাত্র ছড়াকার। এক সময় ডাক পড়লো আমার। আমার মাথায় তখন কবিতা বিষয়ক বিতর্ক এবং বাংলাদেশের শ্লোগান ধর্মী কবিতা বিষয়ক মন্তব্যগুলো ঘুর পাক খাচ্ছে। আমি প্রথমেই বলে নিলাম যে আমরা মাত্র দু’দশক আগে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি। ন’ বছর ধরে স্বৈরশাষণের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করে আমাদের কণ্ঠে এখন আর ফুল, পাখি, লতা-পারার ছড়া আসবে না। শিল্পের যে প্রায়োগিক দিক আছে তার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আমি আমার ছড়া পড়ছি। এই ভূমিকার পরে পড়লাম সেদিনই লেখা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছড়া, তারপর স্বৈরাচার বিরোধী ছড়া। কোলকাতার শ্রোতারা অসাধারণ। বিশেষ করে,
‘বাব্বা! আপনি হুজুর সব টাউটের আব্বা।
আপনি হুজুর চিজ হোতা হ্যায় চাল্লু
চামচাগিরির দোষ দিলে তখন তখন খোশ দিলে পা ধরে কন, তু তো মেরা জানে জিগার খাল্লু
আপনি হুজুর চিজ হোতা হ্যায় চাল্লু!!’
এই ছড়াটি পড়ার পর কেউ কেউ চিৎকার করে বলছেন, ’দাদা আরেকটা হয়ে যাক’। আমি নির্ধারিত সময় পার করে দিয়ে চার চারটা ছড়া পড়লাম। সবশেষে বললাম এবার ছোটদের জন্য ছড়া ’গুলতানি’। এই ছড়াতে একজন কিশোর সমানে গুলমেরে যাচ্ছে, যেমনঃ
’আইনস্টাইন সূত্র যেটা খুঁজে পেলেন মাথায়
সেটাই লিখে রেখেছিলাম বাজার হিশেব খাতায়;
দুদিন আগে হারিয়ে সেটা পেলাম তিরস্কার
হাত ছাড়া তাই হয়েই গেলো নোবেল পুরস্কার।'
........এই লম্বা ছড়াটির সংগে আরও ক’লাইন যোগ করলাম ঐ স্টেজে বসেই।
'পড়তে ছড়া আসতে আমার দেরি হলো আজ
জ্যোতি বসুর সঙ্গে ছিলো খুব জরুরি কাজ
অটোগ্রাফের জন্য ভীষণ হুড়োহুড়ি ভিড়
হাসিস কেন? হিংসা পেটে? গা করে চিড়বিড়? '
শ্রোতাদের কাছে অকল্পনীয় সাড়া পাওয়া গেল। সভাপতি সরল দে মন্তব্য করলেন, ’বাংলাদেশের ছেলে গোল মরিচের ঝাল’। দুই বাংলার কবিতা সম্মেলন শেষ হলো। সেদিন রাতেই রেস্ট হাউসে আড্ডা হচ্ছে। এখন সবাই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াবে। কেউ যাবে শান্িতনিকেতন, কেউ পরিকল্পণা করছে দার্জিলং যাবার। আমার মাথায় কাজ ঘুরছে। সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম নিজের ডেয়ায়, ক্যাপিটাল রেস্ট হাউসে।
আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে বিশেষ কোন কাজ হলো না। তিনি অপারেশন জ্যাকপট বিষয়ে কোন তথ্যই দিতে পারলেন না। মাঝখান থেকে আমার বাড়তি একটা লাভ হলো। দেশ পত্রিকা তথা আনন্দ পাবলিশার্স-এর আঁকিয়ে সুব্রত চৌধুরী আমার কিশোর উপন্যাস ’তুষার মানব’ এর কভার ডিজাইন করে দিলেন। এর মধ্যে খবর পেলাম ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রামনাথ বিশ্বাসের ওপর বই পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ হাই কমিশনে গিয়ে অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল। তাঁরা একটি চিঠি লিখে দিলেন সহযোগিতার বিশেষ আনুরোধ জানিয়ে। সেটি নিয়ে আলিপুর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা করলাম অসীম রায়ের সঙ্গে। তিনি কর্মচারী ইউনিয়েনের নেতা। সব ব্যবস্থা খুব দ্রুত হয়ে গেল। আমি এখন লাইব্রেরির স্কলার হস্টেলে থাকি। প্রতিদিনের চার্জ মাত্র দুই রুপী, তাতে আবার সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার পাওয়া যায়। রাতের বেলা একটু গা ছম ছম করে বটে। কিন্ত এমন সস্তায় থাকা-খাওয়া কোথায় পাই?
হস্টেলের পাশে টিনের শেডের নিচে একটি ছেলে প্রতিদিন রান্না করে। তার সঙ্গে গল্প জমিয়ে বেশ আটার রুটি, সব্জি ভাজি দিয়ে নাস্তা করি। কখনও দুপুরে খিচুরি-ডিম। ছেলেটি বাংলাদেশ শুনে কেমন চোখে যেন তাকায়। বলে আমার বাপ-দাদাও বাংলাদেশে ছিলো, এখানে চলে এসেছে অনেক আগে। ওর কখনও বাংলাদেশে যাওয়া হয়নি বলে খুব আক্ষেপ। বলে, আমার বাবার একজোড়া পালা-খাসি ছিলো, এখানে আসার সময় খাসি দুটো আনতে পারেনি বলে বাবার কি দুঃখ! মাঝে মাঝেই খাসি দুটোর কথা বলে ডুকরে কেঁদে উঠতো বাবা। বলতে বলতে ওর চোখ দুটোও কেমন ভিজে আসে। আমি স্তব্দ হয়ে বসে থাকি উনুনের পাশে। কোলকাতা বইমেলা বেশ জমজমাট। আমি প্রতিদিন বিকেলে বইমেলায় প্রতিক্ষণের স্টলে গিয়ে বসি। এখানে সব নামিদামি লোকজন আসেন। একদিন এলেন চলচ্চিত্রকার মৃনাল সেন, এলেন আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ, আরও কতজন। স্বপ্না দেব সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সবাই ঢাকার ছেলে বলে সস্নেহে কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরেন। ভীষণ ভালো লাগে আমার। কোলকাতায় আমি টানা এক মাস থাকলাম। এই এক মাসে কতো মানুষ, কতো ঘটনা! মেট্রো সিনেমা হলে গিয়ে ঠকের পাল্লায় পরা, রাজারবাগ এলাকায় হিন্দু-মুসলমান টেনশন, ডলার ভাঙ্গাতে গিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে আটকে পরা, রেল স্টেশনের মায়াবী তরুনী, বইপাড়া, আড্ডা, সব কিছু ছাপিয়ে আমার মনে জেগে থাকে আলিপুর লাইব্রেরির সেই কিশোর ছেলেটির যন্ত্রণাবিদ্ধ চোখ। ওর বাবার দুটো পালা-খাসি র জন্য কান্না তো একটা অজুহাত মাত্র। এ যে অন্তর দুই ভাগ হবার যন্ত্রণা, আপন ভিটে-মাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণার ছাপ দেখেছি আমার বাবার চোখেও, যখন তার প্রিয় বন্ধুরা পাড়ি জমিয়েছিলেন কোলকাতায়। এই যন্ত্রণা এখনও বিদ্যমান, তা সেই কোলকাতার অভিজাত শ্রেনীর কোন সাহিত্য-প্রেমীর মাঝে অথবা আলিপুর লাইব্রেরির সেই কিশোর ছেলেটির বুকে। এই যন্ত্রণার ছাপ আমার বুকেও গেঁথে গেলো আজ।
*সাপ্তাহিক যায়যায়দিন এ পূর্বপ্রকাশিত।