Friday, May 18, 2012

‘দেয়াল’ কে উপেক্ষা করাই শ্রেয়তর/ সেজান মাহমুদ
এই মুহূর্তে বোধকরি সবচেয়ে বড় মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কাজ হলো হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা সম্পর্কে খুব বেশি নেতিবাচক কিম্বা  খুব বেশি আক্রমণাত্নক সমালোচনা করা। একাধারে তাঁর অসুস্থতা, অন্যদিকে তাঁর প্রতি লেখক হিসাবে আস্থা-দাবি, আশা-আশাহতের দ্বন্দ্ব। তারওপরে আজকাল সময়ের এতো সংকুলান যে যা আমাকে বুদ্ধিবৃত্তি বা হৃদয়বৃত্তিতে সন্তুষ্ট বা তৃপ্ত করে না তার প্রতি কোন মনোযোগ দিতে চাই না। হুমায়ূন আহমদ এর আজকালকার লেখাগুলো সেই মনোযোগ না পাওয়ার দলের। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালবাসা নিয়ে অনেক লিখেছি আগে। সেগুলো অক্ষুন্ন রেখেই আমার এই মন্তব্য। সম্প্রতি ‘দেয়াল’ নামের একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখেছেন তিনি। পৃথিবীর যাবতীয় তত্ত্ব থেকে বিশ্লেষণ করে ‘দেয়াল’ কে উপন্যাস হিসাবে সমালোচনা করা যায়, করতে পারি। কিন্তু ততোটা মনোযোগ দেবার আগেই এই উপন্যাস সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম এর আলোচনা, প্রকাশিত দুই টি পর্ব আর বিভিন্ন মন্তব্য থেকে, তাই-ই যথেষ্ট এই উপন্যাসের ইতিহাস চেতনা, সত্যতার প্রতি নিষ্ঠা, এমনকি লেখকের দৃষ্টভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলার। আর এই প্রশ্ন তুলতে গিয়ে একটু আক্রমণাত্নক না হয়েও উপায় নেই, তা রবং বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্যের প্রতি মমত্ববোধের জন্যেই জরুরী। এটা বলা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলেই মনে করি।

প্রথমতঃ ‘দেয়াল’ নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা বা সরকারী আইনী আরোপ আমি তার বিপক্ষে। বহুবার এই মত প্রকাশ করেছি যে আমি লেখকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে যদি সরকার লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোন তথ্য পালটে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে থাকেন তাহলে তা ভিন্ন কথা। এক্ষেত্রে আবারো বলবো আদালতের রায় দিয়ে যেন লেখকের লেখা প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা না হয়।

দ্বিতীয়তঃ ইতিহাস ভিত্তিক শিল্প রচনায় লেখকের স্বাধীনতা কতটুকু, বা লেখকের নৈতিক কোন দায় আছে কি না এ প্রশ্ন করা অসংগত কিছু নয় , আবার এর উত্তরও সাহিত্য-সমালোচনার ইতিহাস থেকে খুঁজে নেয়া যায় সহজেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইতিহাস সবসময়ই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। হয়তো স্পর্শকাতর না হলে তা ইতিহাসই হয় না। তাই এই স্পর্শকাতরতা বিচার করতে ইতিহাস এর সময়কাল, অতিক্রান্তকাল, সত্যতার প্রতি ন্যায়নিষ্ঠতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে করাই সংগত। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাম্প্রতিক ইতিহাস কে বেছে নিয়েছেন। ইতিহাসের কাছে সাইত্রিশ বছর একেবারেই কিছু না। অন্যদিকে যে বিষয়কে বেছে নিয়েছেন তা বোধকরি জাতির জন্য সবচেয়ে কলঙ্কের, সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এখানে সব সময় মনে রাখা দরকার যে ‘ইতিহাসের সত্য আর শিল্পের সত্য এক নয়’। এই সত্য অর্থ কিন্ত আবার শুধু তথ্য নয়। সত্য হতে পারে ইতিহাসের পূর্ণনির্মাণ, ইতিহাসের অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থকে ডিসাইফার করা, হতে পারে ইতিহাসের ডিকন্সট্রাকশন। যতোদূর জানতে পারছি, কিম্বা এর আগেও হুমায়ূন আহমেদ এর ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ পড়ে মনে হয় না এগুলোর কোনকিছুর চেষ্টা করা হয়েছে কথিত ‘দেয়াল’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের প্রেস-কপি ওপর ভিত্তি করে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম আলোচানা লিখেছেন। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, নিজেও গল্পকার, সমালোচক, ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে হূমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাসের প্রশংসা করেছেন, শুধু ‘দেয়াল’ কেই নয়, ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ কেও একই প্রশংসার উচ্ছাসে ভরিয়েছেন। তাঁর ভাষায় ‘এই উপন্যাসে তিনি (হুমায়ূন আহমেদ) কোনো ইতিহাসবিদের জায়গা নেননি, যদিও একজন ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্যনির্ভরতা তিনি বজায় রেখেছেন।’

এখন আদালতের আদেশ ও অন্যান্য আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারছি আসলে হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসবিদের মতো বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্য-নির্ভরতা বজায় রাখেন নি। অন্তত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এর ব্যত্যয় দেখা গিয়েছ। একটি শেখ রাসেলের মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনায়, অন্যটি এই পটভূমির খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চরিত্র ‘খন্দকার মোস্তাক আহমেদ’ এর ভূমিকায়। যদিও খুনীদের প্রতি একধরণের মমত্ববোধ তৈরির ‘ভিউ পয়েন্ট’ বা দৃষ্টিভঙ্গিও  প্রকাশ পেয়েছে এমনটি জানা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আত্মস্বীকৃত খুনিদের অন্যতম মেজর ফারুক যুদ্ধের শেষ দিকে এসে পক্ষ নিলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার সময়-সুযোগ পাননি। কিন্তু তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে দিয়ে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলা যায়। আমি যেহেতু পুরো উপন্যাটি পড়তে পারি নি তাই উপন্যাসের সার্থকতা ইত্যাদি আলোচনা না করে একটি ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস হিসাবে ‘দেয়াল’ এর ইতিহাসের তথ্যের প্রতি সততা, দায়বদ্ধতা এবং সাহিত্য হিসাবে পরিনতি কী হতে পারে তার দিকে অল্প আলোক প্রক্ষেপণ করবো। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের ইংরেজি সাহিত্য, সাহিত্য তত্ত্ব এবং সাহিত্য ইতিহাসে ইতিহাস-নির্ভর সাহিত্য নিয়ে জ্ঞানের প্রতি আমার কোন সংশয় নেই। আমি বরং প্রশ্নাকারে তাঁকেও জিগ্যেস করতে পারি কেন তিনি দেয়াল কে বস্তনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ তথ্য-নির্ভর বলেছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস, নাটক বা এপিক কাব্য নিয়ে যারা বিস্তর লিখেছেন তাঁদের মধ্যে জার্মান লেখক, জীববিজ্ঞানী গ্যোটে (Goethe), দার্শনিক হেগেল, রুশ কবি পুশকিন এবং সাহিত্য সমালোচক বেলিনস্কি বোধকরি একই ধরণের তাত্ত্বিক ধারণা পোষণ করতেন, তা হলো,
“..The writer’s historical fidelity consists in the faithful artistic reproduction of the great collisions, the great crises and turning points of history.”

এই শিল্পিত বিনির্মাণে লেখক বা শিল্পীর অপরিসীম স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু যখন শিল্পকর্মটি বিচার করা হয় তখন অতিক্রান্ত কাল খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিরাজুদ্দৌলা নাটকে ইতিহাসের চরিত্রগুলো রূপায়ন করতে গিয়ে মীর জাফর কে এতোটাই বেঈমান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যে ‘মীর জাফর’ এখন বেঈমানী বা কৃতঘ্নতার সমার্থক। এখন একজন লেখক দাবি জানিয়েছেন যে ইতিহাসে আসলে মীরজাফর এর চেয়ে মোহন লালের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল বেশি কিন্তু নাটকে দ্বিজেন্দ্র লাল রায় তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছিলেন। আমি ঘটনার সত্যতা জানি না, বা এই আলোচনায় জানারও প্রয়োজন নেই। যদি ঘটনাটা সত্যিও হয় এখন এই দীর্ঘ অতিক্রান্তকালে তা আর ইতিহাসের কোন ক্ষতি করবে না, বর্তমান বাস্তবতারও কোন ক্ষতি করবে না। বরং এই নতুন তথ্য হিসাবে ইতিহাসে অন্তর্ভূক্তি পেলেও নাটক হিসাবে সিরাজুদ্দৌলা সেই আগের অবস্থানেই থাকবে এবং মীরজাফর সেই মীরজাফরই থেকে যাবেন। কিন্তু উপন্যাস ‘দেয়াল’ এমন একটি সময়ের যা থেকে অতিক্রান্ত কাল মাত্র সাইত্রিশ বছর। সমসাময়িক ঘটনাভিত্তিক রাজনৈতিক উপন্যাস, বা ইতিহাস-নির্ভর লেখায় এই দায়বদ্ধতার অন্য মাত্রা আছে। আমার কাছে শেখ রাসেলের মৃত্যু দৃশ্যটির পরিবর্তনটি এমন কোন গুরুতর বিষয় নয়, বরং হয়তো ঘটনাকে আরো নাটকীয় এবং মর্মস্পর্শী করে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খন্দকার মোস্তাক আহমেদ এর বঙ্গবন্ধু কে হত্যার ঘটনা থেকে দূরে রাখা বা অনবহিত দেখানোর অনেক বড় রাজনৈতিক মাত্রিকতা আছে। সেই মাত্রিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং তদপরবর্তী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মকান্ডের আইনী দিকের সঙ্গেও জড়িত। বিশেষ করে দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিচার করার প্রস্তুতি চলছে, এবং কালক্রমে হয়তো বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারও পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে, এমতবস্থায় শুধু উপন্যাস রচনার নামে ইতিহাস নিয়ে এই হঠকারীতা প্রশ্ন সাপেক্ষ বৈ কি।অন্যদিকে ইতিহাসের উপাদানকে শিল্পে ব্যবহার এবং রূপান্তরের যে আঙ্গিকগত নিরিক্ষা সারা পৃথিবী জুড়ে দেখা যায়, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে ঋদ্ধ, সংহত, গবেষকের নিষ্ঠা নিয়ে লেখার প্রবনতাকেও লক্ষ্য করা যায় না।
 এই প্রসঙ্গে আমেরিকার পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, আমার বন্ধু বলেও যাকে দাবি করতে পারি সেই রিক ব্র্যাগ এর কথা স্মরণ করি। আমি ‘রিক ব্র্যাগঃ জীবন ছোঁয়া এক গল্পের রূপকার’ শিরোনামে লেখা লিখেছিলাম তাঁকে নিয়ে। “রিক ব্র্যাগ (Rick Bragg)। রিক শুধু একজন সাংবাদিকই নন, একজন তুখোর গল্পকারও। কিন্তু তিনি গল্প লেখেন সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে, সরেজমিনে তদন্তের পর। নিউ ইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য তিনি ইতোমধ্যেই পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার (Pulitzer Prize), আমেরিকার সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকমন্ডলী প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার, আমেরিকান সোসাইটি অব নিউজ পেপারস এডিটর’স ডিসন্টিংগুইশড রাইটিং এওয়ার্ড পেয়েছেন দু’দুবার। এছাড়াও চল্লিশটি ছোট-বড় সাংবাদিকতার পুরস্কার তার ঝুলিতে। সুতরাং রিক যে একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি রিক ব্রাগ আলোচিত হয়েছেন আবার, যখন তিনি ইরাক যুদ্ধে আমেরিকান মহিলা যুদ্ধবন্দী বা প্রিজনার অব ওয়ার (Prisoner of War) জেসিকা লিঞ্চ (Jessica Lynch)-এর জীবনীভিত্তিক একটি বই লেখার জন্য মোটা সন্মানীর (3 million dollar) বিনিময়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।“ যারা জানেন বা জানেন না তাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য বলি, জেসিকা লিঞ্চ ছিলেন আমেরিকার একজন সাধারণ সৈন্য। ইরাকের যুদ্ধের সময় জেসিকার সঙ্গীদল মরুভূমির মধ্যে ইরাকী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তাঁর সঙ্গের চারজন সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। জেসিকা কে যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধরে নিয়ে যায় সাদ্দাম বাহিনি। সেখানকার হাসপাতাল থেকে পরে তাঁকে আমেরিকান বাহিনি উদ্ধার করে নিয়ে আসে। দেশে ফেরার পরে বুশ সরকার জেসিকার বীরত্ব, আত্নত্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক মিডিয়া প্রচার করতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে রিক ব্র্যাগ জেসিকার জীবন ভিত্তিক গ্রন্থ রচনার জন্য চুক্তিভূক্ত হন। এখানে লক্ষ্যনীয় যে রিক ব্র্যাগ সব সময় সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা লিখেছেন। তাঁর নিষ্ঠার জন্য, অসাধারণ গল্প বলার জন্য এবং বিশ্বাসযগ্যতার জন্য তিনি ছিলেন একেবারে প্রশ্নাতীতভাবে সম্মানীয়।

রিক ব্র্যাগ লিখেছেন সাউথ ক্যারোলিনার সুসান স্মিথের কথা। মাত্র তেইশ বছর বয়েসের এই মা তার দুই ছেলে, তিন বছরের মাইকেল এবং চোদ্দ মাসের আলেকজান্ডার স্মিথ কে গাড়িতে রেখে নদীতে ডুবিয়ে দেন গাড়িটি। তারপর পুলিশকে খবর দেন এই বলে যে এক কালো ষন্ডামার্কা লোক তার গাড়িটি হাইজ্যাক করেছে তার দুই ছেলেসহ। পুলিশি অনুসন্দ্ধানে যখন জানা গেল আসলে এই মা-ই তার দুই ছেলের খুনী তখন সাড়া আমেরিকায় হইচই পরে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সকলের চোখে এই সুসান স্মিথ একজন খুনী, সামাজবিরোধী ব্যক্তি। রিক তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ধারাবাহিক লিখলেন এই সুসান স্মিথের ওপর। তার লেখায় বের হয়ে এলো তেই বছরের এই মায়ের করুন কাহিনী। সেই ছোটবেলা থেকে সৎ বাবার যৌন অত্যাচার, স্বামীর নির্যাতন আর অভাবের পেষণে কি করে এই তরুণী হয়ে ওঠে এক মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। রিকের লেখায় বের হয়ে আসে সভ্য সমাজের অন্তরালে জেগে ওঠা দুষ্ট ক্ষতের মতো গ্লানিকর ইতিহাস। আইনের বিচারে দোষী এই তরুনী, সমাজের চোখে নৃশংস এই মা হয়ে ওঠেন এক ট্রাজিক গল্পের নায়িকা।

আমি রিক ব্র্যাগ কে জেসিকা লিঞ্চ কে নিয়ে লেখা বই প্রসঙ্গে জিগ্যেস করেছিলাম এভাবে,

‘তোমার বাবা ছিলেন কর্মবিমূখ মদ্যপ, মাতাল, আমার বাবাও ছিলেন কর্মবিমূখ, ফুটবল-পাগল বা ফুটবলের মাতাল। তুমি এদেশের স্বনামখ্যাত লেখক, আমিও আমার ভাষার ক্ষুদ্র লেখক। এবার বলো একজন লেখক যখন জনপ্রিয় হন, তখন সবচেয়ে বড় কম্প্রোমাইজ বা আপোষ তাকে কিসের সাথে করতে হতে পারে?'

রিক কিছুক্ষণ একেবারে চুপ থাকার পর বললেন, তুমি যদি আমাকে সোজা প্রশ্নটি করতে তাহলে আমিও সহজে উত্তর দিতে পারতাম। আমি জানি তোমার ভূমিকাটি অহেতুক নয়। আমি জেসিকা লিঞ্চ-এর ওপর বই লিখতে সম্মত হয়েছি, জেসিকা আমাদেরই একজন। যদি এই লেখাটিতে আমি আমাদের মানুষের গল্প বলতে না পারি তাহলে এটাই হবে আমার ব্যর্থতা, এটাই হবে আমার কম্প্রোমাইজ বা আপোষ। আমি খুশি হলাম এই ভেবে যে রিক আমার ঈঙ্গিতটা ধরতে পেরেছেন এবং সৎ ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। রিক এতোদিন লিখে এসেছেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কথা, যে কারনে তার আজ এতো খ্যাতি। আমেরিকার কোন যুদ্ধ-বন্দীকে নিয়ে লিখতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই জেসিকা লিঞ্চের ঘটনার সঙ্গে রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোই জড়িত। তাই রিকের এই অকপট স্বীকারোক্তিতে তার প্রতি আমার মুগ্ধতা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

এবার লক্ষ করুন প্রকৃতপক্ষে কি ঘটলো এই জেসিকা লিঞ্চ কে নিয়ে। বইটি বের হবার মাত্র কিছুদিন আগে জেসিকা লিঞ্চ টিভি সাক্ষাতকারে জানালেন তাঁকে নিয়ে যে বীরত্বের কাহিনি প্রচার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তিনি আসলে বীরের মতো যুদ্ধ তো করেনই নি, রবং যখন তাঁর দল আক্রান্ত হয়েছিল তিনি ভয়ে ট্রাকের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এবং পাল্টা গুলি করতে ভুলে গিয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর চার সঙ্গীর মৃত্যু হয়। তিনি কোনভাবে বীরের খেতাব বা মিথ্যা প্রাপ্তির কথা জীবনের এই সন্ধিক্ষণে এসে গ্রহণ করতে পারবেন না। এখন লেখক হিসাবে রিক ব্র্যাগ এর কি দায়িত্ব? তিনি তো আর ইতিহাসের বই লিখছিলেন না, ইতিহাস নির্ভর লেখা লিখছিলেন। তিনি কি এই মিথ্যাচার গ্রহণ করতে পারতেন না? কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং এই জেসিকা লিঞ্চের সেই দারিদ্রপীড়িত ছোট বেলা, সত্যতার প্রতি অনুরাগ, কষ্টকর জীবন-যাপন তুলে আনলেন তাঁর লেখায়, ‘আই এয়্যাম এ সোলজার টু’ গ্রন্থে। তাঁর পরও শুধু এইরকম মিথ্যাচার এর গল্প লেখার কারণে পাঠকের কাছে বিরাট আকারের খেসারত দিতে হলো রিক ব্র্যাগ কে, তিনি প্রায় প্রত্যাখ্যাত হলেন পাঠকের কাছে, সমালোচকের কাছে।

অন্যদিকে একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লেখার জন্য যে গবেষণা, তথ্যের বিশ্লেষণ, নানা রকমের প্রেক্ষিতকে পর্যলোচনা করে সত্যের সার অংশটুকু তুলে আনার জন্য যে পরিশ্রম এবং ধী-শক্তি তার কতটুকু ব্যয় হয়েছে এই উপন্যাসে এরকম প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেমন, বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে সে সময়ের বেশিরভাগ লেখা্তেই কোন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হুমায়ূন আহমেদ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখার সূত্র ধরে যে সব তথ্য দিয়েছেন তা তিনি যাচাই করেন নি যেমন আমরা জানি, তেমনি এও জানি যে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস কীভাবে সামরিক জান্তার যোগসাজশে অনেক বানোয়াট লেখা লিখেছেন। কারো কারো লেখায় এমন কি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেও এরকম ধারণা উঠে এসেছে যে একদল রাগী, তরুন সামরিক অফিসার শেখ মুজিব কে হত্যা করছে। এই ধরণের সরলীকরণ শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তিধরদের আড়াল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। না হলে এই খুনীরা কী করে সেই সময়ের আরেক ডিক্টেটর গাদ্দাফির কাছে আশ্রয় পেয়েছিল? এদের বিচার করতে বরাবরই  (এতোদিন) পরাশক্তির বাধাই বা এসেছে কেন? গাদ্দাফি কাদের সৃষ্ট একনায়ক, এধরণের প্রশ্নের মধ্যে দিয়েও অনেক সত্য বেরিয়ে আসে। সাহিত্যিকের কাজ প্রকৃতপক্ষে একজন ইতিহাসবিদের চেয়েও কঠিন! তাই এই উপন্যাস পড়ে পাঠক বরং জানবেন খন্দকার মোস্তাক শেখ মুজিব হত্যার কিছু জানতেন না, কর্ণেল ফারুক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, দরদী মনের পীর বংশীয় মানুষ। সুতরাং তাঁদের কৃত-কর্ম নিয়ে একধরনের নরোম মনোভাব তৈরি হতেই পারে।

হুমায়ূন আহমেদ ভাগ্যবান যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষা-বঞ্চিত, যারা শিক্ষিত তাদের মধ্যেও আবার বড় অংশ কুশিক্ষিত, অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শে অন্ধ। সাহিত্য সমালোকদের মধ্যেও নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তা না হলে এই ইতিহাস ভিত্তিক রচনায় যদি সত্যি প্রমাণিত হয় যে মোস্তাক আহমেদ আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার সব কিছু জানতেন (আমার জানা যতো তথ্যভিত্তিক গ্রন্থ আছে তাতে মনে হয় মোস্তাক আহমেদ শুধু জানতেনই না, হয়তো জড়িতও ছিলেন) তাহলে এই বিকৃতি তা যতোই উপন্যাস সৃষ্টির নামে হোক না কেন, তার দায়ভার হুমায়ূন আহমেদ কেই নিতে হবে। শিল্পের সত্য আর ইতিহাসের সত্য এক না হলেও শিল্পের প্রতি যে নিখাদ নিষ্ঠতা দেখাতে হয় তার অভাবের জন্য তাঁকেও হয়তো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে একদিন। হয়তো বিকৃতির অভিযোগে এই বই আস্তাকুঁড়ে ছূড়তেও দ্বিধা করবে না কেউ। আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা এই ভিউপয়েন্ট থেকে লাভবান হবেন তাঁরা মাথায় তুলে নাচবেন ঠিকই। এখন প্রশ্ন হলো এই দ্বিধা-বিভক্ত জাতিগত মানসে হুমায়ূন আহমেদ আরেকটি বিভক্তির বিষ ইঞ্জেকট করে যাবেন নাকি সবশেষে এদেশের ইতিহাসের এক ট্রাজিক নায়কের মর্মান্তিক পরিনতি সকল কে ন্যুব্জ, অশ্রুসিক্ত করবে? পূর্ববর্তী কর্মের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর যে মানসের পরিচয় পাই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাঁর কাজে সেটা আশা তো করা যাচ্ছেই না, বরং ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক একধরণের সূক্ষ্ণভাবে মুক্তযুদ্ধবিরোধীদের প্রতি নরোম জায়গা তৈরি করে দিচ্ছেন। এই সংশয়, সেই পরিনতির দিকে তাকিয়ে, লেখকের স্বাধীনতার দিকে তাকিয়ে মনে হয় ‘দেয়াল’ কে  উপেক্ষা করাই শ্রেয়তর!

Sunday, January 22, 2012

হার্ভার্ডের স্মৃতিঃ অমর্ত্য সেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদানকারী কয়েকজন অসামান্য আমেরিকান


১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার কাছে একটি নিমন্ত্রণপত্র এলো; তাতে লেখা, "Harvard Center for Population and Development Studies invites you to a Birthday party for Bangladesh".

আমি তখন আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশীপ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়ালেখা করছি। এই ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার কিছু নেই। আমেরিকার কেমবৃজ ও বস্টন শহর জুড়ে এই ইনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, পৃথিবী-জোড়া সুখ্যাতি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অন্যতম প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। সর্বমোট তেতাল্লিশজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী-শিক্ষক আছেন এখানে, এবং প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছে। কেমবৃজ শহরে হার্ভার্ড স্কয়ারে কফি শপগুলোতে ঢুকতে গেলে কোন নোবেল

লরিয়েটের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে- এরকম কৌতুকও চালু আছে। এই ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট রিং বা আংটির বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এভাবে-
‘প্রতি চারজন আমেরিকানের একটি করে বাড়ি আছে,
প্রতি একশজনের একটি করে জেট,
প্রতি ২৪০ জনের একটি করে ইয়ট-
কিন্তু প্রতি ১৭ হাজার আকেরিকানের একজন মাত্র এই আংটিটি পরতে পারেন।’

সেই হার্ভার্ডের ক্যাম্পাসে পালিত হবে বাংলাদেশের পচিশতম জন্মবার্ষিকী! তাতে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়নের ওপর আলোচনা ও নৈশভোজ। আলোচনা অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু নৈশভোজ শুধু আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। আমার কাছে এই রহস্যটি এখনও অজানা যে, আমি কী করে সেই নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম! কেন এটি বিষ্ময়কর তা আমন্ত্রিত অতিথিদের নাম জানলেই পরিস্কার হয়ে যাবে। প্রতিটি চেয়ারে আমন্ত্রিত অথিতিদের নাম শেষ নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে সাজানো। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথিবৃন্দ। আমার অফিসিয়াল নামের প্রথম অক্ষর ’আর’। সেকারনেই আমার ডান পাশে বসেছেন অমর্ত্য সেন, বাম পাশে বস্টন ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রফেসর দম্পত্তি হান্না ও গুস্তাফ পাপানেক। অমর্ত্য সেন তখন নোবেল পুরস্কার না পেলেও ইউনিভার্সিটি চত্বরে সবার মুখে মুখে শোনা যায় তাঁর নাম, একারনে যে নোবেল পাওয়া তাঁর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি হেলথ পলিসি বিষয়ে পড়ার সুবাদে তাঁর অর্থনীতি বিষয়ে লেখা এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্যে তাঁর দর্শন বিষয়ক লেখাগুলোর সঙ্গে পরিচিত। কখনো কেমবৃজ ক্যাম্পাসে তাঁর ক্লাসে বসে শুনেছি ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্স নিয়ে তাঁর তুখোর ও রসালো বক্তব্য। রসালো বলার কারণ হলো, তিনি অসাধারণ বাকপটু এবং মারাত্নক কথাগুলো রসিকতা করে বলতে পারেন। যেমন এই অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে যখন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান এবং ড. আবু আবদুল্লাহ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ভীষণ আশাবাদী বক্তব্য রাখলেন, অমর্ত্য সেন শুরুতেই বাঙালির অতিরঞ্জন প্রিয়তার প্রতি ইঙ্গিত করে রামমোহন রায়ের গানটি শুনিয়ে দিলেনঃ
’মনে করো শেষের সেদিন ভয়ংকর
অন্য বাক্য কবে কিছু তুমিই রবে নিরুত্তর।’

অর্থাৎ একমাত্র মৃত্যু হলেই আমরা মুখ বন্ধ রাখি। যা হোক, সেই অমর্ত্য সেন পাশে বসেছেন। আমি অনেকটা আনন্দে দিশেহারা। নৈশভোজে আরও এসেছেন হার্ভার্ডের প্রফেসর লিংকন চেন, মার্টি চেন, রিচার্ড ক্যাশ, ওমর রহমান (যিনি বর্তমানে বাংলাদেশে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, এবং আমার একাডেমিক আদর্শ), এম আই টি’র প্রফেসর রিচার্ড তাব্যুর। আরও এসেছেন ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্লড রিপোর্টের সাংবাদিক এমিলি ম্যাকফার কোহার। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ডক্টর রেহমান সোবহান, এবং ডক্টর আবু আবদুল্লাহ। এখানে আমন্ত্রিত আমেরিকান নাগরিকদের সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোন ভাবে অবদান রেখেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকান সরকারের ভূমিকা সম্পূর্ণ বিরোধী হওয়া সত্বেও এই দেশের অনেক বিবেকবান, মহৎ নাগরিক নিজস্ব তাগিদে অসামান্য অবদান রেখেছেন। মানবতার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানানোর এই অবদানগুলোর কথা বলতে গেলেই ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত পন্ডিত রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর গানটির কথা চলে আসে সবাগ্রে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমেরিকাতে প্রথম কনসার্টটি করেছিলেন ওস্তাদ আকবর আলী খান, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে মে মাসের ২৮ তারিখে। তারপরই শিল্পী জোন বেজ দুটি কনসার্ট করেন- একটি স্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাসে, অন্যটি মিশিগান ইউনিভার্সিটির অ্যান আরবর ক্যাম্পাসে। দুটি ক্যাম্পাসেই ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো লোক সংখ্যা ছিল।

এই শিল্পী গেয়েছিলেন সেই গানটিঃ
'When the sun shines in the West
Die a million people in Bangladesh"

এই গানটির কথা আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। সঙ্গীতের বিশ্বজনীন আবেদন নিয়ে এ শিল্পীরা আমাদের আবেগ-অনুভূতির মর্মমূলে নাড়া দিয়েছিলেন বলেই মনে হয় এ ঘটনাগুলো আমাদের সবার স্মৃতিতে অমর হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের অনেকেই ছিলেন যাদের এই শিল্পের ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু অসামান্য হৃদয়বোধ, মানবিক উৎকর্ষতা নিয়ে তারা সমর্থন জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। সেই সমর্থনের ভাষাও কখনো কখনো হয়ে উঠেছিল শিল্পের সমতূল্য। আজকের অনুষ্ঠানে তাদের অনেকেই উপস্থিত।
পাপানেক দম্পত্তি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ করেছেন। বস্টন ইউনিভার্সিটির বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই পাকিস্তানের বাধা দেয়ার কারণে দেশ থেকে টাকা পয়সা পাচ্ছিলেন না। এই দম্পতি নিজেদের বেতনসহ আরও অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুস্তাফ পাপানেক অন্য দুজন লেখকের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি পজিশন পেপার লিখেছিলেন। তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ এই দম্পতির ঘটনা ছাপা হবার পর এই সহৃদয় যুগল চাকরী হারান। এঁরা দীর্ঘ সময় হার্ভার্ডের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। এই হান্না পাপানেক অনুষ্ঠানের শুরুতেই আক্ষেপ করে বললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র পচিশ বছর পরেই বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলে তিনি হতাশ হয়েছেন; তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন আগ্রহই নেই। তিনি এই তরুন প্রজন্মের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তনয় জয়ের কথাও উল্লেখ করলেন।

আমি ততোক্ষণে এই অষ্ঠবজ্র সম্মেলনের ধাক্কা কিছুটা সামলে উঠেছি। হান্না পাপানেকের এই কথার পর আমি হাত তুললাম। বললাম, আমি বিনয়ের সঙ্গে এই কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল চার-পাঁচ বছর। সেই অর্থে আমিও তরুন প্রজন্ম। অথচ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ অপরিসীম, এবং অনেক তরুন তরুনীই আমার মতো। আরো বললাম, মুক্তিযুদ্ধ আমার কতোটা অন্তর্গত বিষয় তার প্রমাণ হলো আমার লেখা প্রকাশিত ১৫ টি গ্রন্থের প্রায় অর্ধেকই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। এর মধ্য অপারেশন জ্যাকপট ও মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই দুটি প্রমাণ্য গ্রন্থ। (এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় তার জীবনে যে অপরিসীম দুঃখ পেয়েছেন আত্নীয় পরিজন হারিয়ে, তাতে তার অভিমান হলেও দোষ দেয়া যায় না, যে অভিমান আমারও আছে। একদিন হয়তো সেই অভিমানের আগুন বুকে নিয়ে এই নতুন প্রজন্মই বাংলাদেশের নেতৃত্বের হাল ধরবে, আজকে জয়ের সেই অগ্নিময় প্রস্তুতি আমরা দেখতে পাই)।
ডক্টর রেহমান সোবহান সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সমর্থন জানিয়ে বললেন যে, তিনি অপারেশন জ্যাকপট বইটি সম্পর্কে অবহিত কিন্তু এটা জানতেন না যে লেখক বয়সে এতো তরুন।
হান্না পাপানেক সহাস্যে বললেন, তাহলে আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সিলভার জুবিলি-তে বাংলাদেশের কেকটি কাটার দায়িত্ব তোমার এবং তুমিই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইবে। সকলেই উঠে দাঁড়ালেন। আমি কেক কাটলাম যাতে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা। প্রাণ খুলে গাইলাম, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। অবাক ব্যাপার হল এখানে উপস্থিত অনেক আমেরিকানই গলা মেলালেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে। আবেগে, আনন্দে আমার দুচোখ বেয়ে নেমে এলো খুশীর অশ্রুধারা!

ষাটের দশকে ঢাকায় SEATO কলেরা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল যার বর্তমান নাম আই সি ডি ডি আর, বি। এখানে একদল চিকিৎসক গবেষেক ছিলেন যাদের মধ্য অন্যতম জিম টেলর, তাঁর স্ত্রী অ্যানা টেলর, লিংকন চেন, মার্টি চেন, রিচার্ড ক্যাশ, জন রড, কর্নেলিয়া রড, হেনরি মোসলে, ডেভিড নালিন, উইলিয়াম গৃনাফ এবং রবার্ট হির্শনে। ঢাকায় ২৫ মার্চের পাকিস্তানি আক্রমণের পর এরা সবাই বাংলাদেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে আসেন এবং হার্ভার্ড, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। এখান থেকেই নানান ফোরামে, নানানভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানাতে থাকেন। এঁদের মধ্য লিংকন চেন এবং রিচার্ড ক্যাশ পরবর্তীতে আমার সরাসরি শিক্ষক হয়েছিলেন। তাঁদের কথায় আসার আগে টেলর দম্পতির কথা বলে নিই। জিম এবং অ্যানা টেলর দুজনেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্নক সমর্থন দিয়েছিলেন, প্রতিবাদের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিলেন আমেরিকার বুকে। বিশেষ করে অ্যানা টেলর মার্চের কালো রাতের ভয়াবহতা জানার পর পর মে মাসেই দুবার প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিলেন ওয়াসিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসের সামনে এবং পাকিস্তান অ্যাম্বাসির সামনে। শুধু তাই নয়, এই চিকিৎসক দম্পতি হোয়াইট হাউসের সামনে ম্যানহোলের ভেতরে রাত কাটিয়েছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষকে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশা বোঝানোর জন্য যে এভাবে ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে পাইপের ভেতরে জীবন যাপন করছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা!

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যতগুলো রিপোর্ট বা পজিশন পেপার জমা দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী লেখাটি লিখেছিলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির তিনজন শিক্ষক; এডওয়ার্ড মেসন, রবার্ট ডর্ফম্যান এবং স্টিফেন মার্গলিন। ২৫ মার্চের কালো রাতে যখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর চলছে নির্মম ব্রাশফায়ার, বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে আমেরিকান সরকার সরাসরি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বর্বর শাসকগোষ্ঠীকে, তখন এপ্রিল মাসে তাঁদের এই লেখাটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তারলাভ করতে সমর্থ হয়েছিল আমেরিকার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবি মহলে।
লেখাটির শুরুই হয়েছিল এভাবেঃ "The Indepence of East Pakistan is Inevitable" শুধু তাই নয়, এ লেখাতেই প্রথম Bangladesh কে একটি আলাদা শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়; Indipendence of East Pakistan-Bangladesh is a matter of time.

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এটি একটি অসামান্য অবদান। এই লেখা আমেরিকার সিনেটের সাবকমিটিতে পাঠানো হয়। ডক্টর মেসন স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন। তাঁর নামে প্রবর্তিত মেসন প্রোগ্রামে বাংলাদেশের অনেক সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তা বিশেষ ট্রেনিং নিতে আমেরিকায় এসেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে।
চাইনিজ বংশোদ্ভূত চিকিৎসক এবং পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ লিংকন চেন এবং তাঁর স্ত্রী মার্টি চেন, একই পেশার জন রড ও তাঁর স্ত্রী কর্নেলিয়া রড ছিলেন বাংলাদেশের একনিষ্ঠ সমর্থক। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় লিংকন চেন ও জন রড পৃথিবীর অন্যতম খ্যাতনামা জার্নাল ল্যানসেট-এ বাংলাদেশের ওপরে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এটি আমেরিকার অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নজরে আসে। অক্টোবর মাসে সিনেটের কেনেডি এই রিপোর্ট প্রবন্ধের ওপরে একটি শুনানীর আয়োজন করেন। সেখানে এই প্রবন্ধের আরো বিস্তারিত বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা দেন ডক্টর রিচার্ড ক্যাশ। মার্টিন চেন ও জন রড স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের এন জি ও সেক্টরে সক্রিয় অবদান রেখেছেন।

চিরকুমার রিচার্ড ক্যাশ একজন মানব দরদি চিকিৎসাবিদ ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ। আমরা ছাত্রেরা তাঁকে নাম দিয়েছিলাম ক্যাশলাদেশ। অর্থাৎ ক্যাশ + বাংলাদেশ = ক্যাশলাদেশ। এর যথার্থ কারণও ছিল। তাঁর প্রতিটি ক্লাসে, উদাহরণে বাংলাদেশের ঘটনা, কখনো দুই একটা বাংলা শব্দ বা বাক্যও চলে আসতো তাঁর মুখে। কেমব্রীজ শহরে তার বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম কয়েকবার। ঘরের সাজানো প্রতিটি জিনিশ বাংলাদেশের বা আফ্রিকার কোন দেশের। এমন কি তার প্রতিদিনের শয্যার ওপরে আমেরিকান কমফোর্টার এর বদলে শোভা পায় বাংলাদেশের আড়ং এর তৈরি নকশীকাঁথা। বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থন শুধু মুক্তিযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, তার জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্যে, জীবন দর্শনের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠান শেষে সবার সঙ্গে আলাদা আলাপকালে কথা হলো। অমর্ত্য সেন স্নেহের ভঙ্গিতে পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিলেন। বললেন, আমার সেক্রেটারিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিও (যা আর কখনও করা হয় নি), আর আমি কেমব্রীজ এর খোলা চত্বরে বেড়িয়ে আমার বুকের উথাল-পাথাল ঝড় কে অনুভব করি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলাদেশের জন্মবার্ষিকী পালন করছি বিশ্বময় খ্যাতিমান এই মানুষগুলোর সঙ্গে। এই আনন্দের মর্মাথ আরও গভীর হলো, খোলাসা হলো আমার কাছে যখন একই বছরের অক্টোবরে ঘটে-যাওয়া আরেকটি ঘটনা মনে পড়লো। সে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা!

১৯৯৬ সালে ঠিক এই সময়ে জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিতে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পর পরই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে তিনি কেমব্রীজ ক্যাম্পাসে বক্তব্য রাখেন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক, সময়পোযোগী বক্তৃতা। বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করার জন্য। এখানে তিনি প্রচন্ড আবেগময়, আবার রাজনৈতিকভাবে তেজি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডির সেই বিখ্যাত উক্তিঃ
‘Let every nations know ...whether it wishes us well or ill..
that we shall pay any price, bear any burden, meet any hardship, support any friend, oppose any foe,to assure the survival and success of liberty..."

আর এই বক্তৃতা তিনি শেষ করেছিলেন আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট এর সেই বিখ্যাত লাইন দিয়েঃ
"I have promises to keep and miles to go before sleep"

এই আবেগঘন এবং প্রাণস্পর্শী বক্তব্যের পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে আমি প্রথম প্রশ্নটি করেছিলাম। আমার প্রশ্নটি ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় অনেক, কিন্তু তা রাখা হয় না। আপনার সরকার বাংলাদেশে একটি উপযুক্ত স্বাস্থ্যনীতির কথা বলে আসছে বহুদিন থেকে। কবে আমরা একটি আধুনিক, এবং সময়োপযোগী স্বাস্থ্যনীতি পবো? তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা বলেছিলেন। এখন, এতো বছর পরও আমরা তাঁর উদ্দেশ্য সেই একই প্রশ্ন ও দাবি রাখতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তৃতা ছাড়াও আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্ব ঘটনা ঘটে একই সময়ে, যার সঙ্গে আমার প্রথমে বর্ণিত ঘটনার একটা গভীর যোগসূত্র আছে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন কে কেন্দ্র করে বস্টনে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্য থেকে একটি উদ্যোগ নেয়ে হয় যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে সব হূদয়বান আমেরিকান নাগরিক সরাসরি সাহায্য করেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাঁদেরকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ সম্মাননা দেয়া হবে। বস্টনের টাফট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সে রকম সতেরজন আমেরিকানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হার্ভার্ডের বাংলাদেশের জন্মদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই ছাড়াও, আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন প্রফেসর রবার্ট রাইন। যিনি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকান আইনকে ফাঁকি দিয়ে ৯৬ হাজার ডলারের যন্ত্র-সরঞ্জাম মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় আওয়ামীলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এই মহতি উদ্যোগের পেছনে যে মানুষটি মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন তৎকালীন বোস্টন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, বর্তমানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ডক্টর আবদুল মোমেন। তাঁর যোগাযোগ ও পরিকল্পণার মধ্য দিয়ে সব কিছু আগালেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় রাজনীতির কারণে তাঁকে এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল, যা আমার মনে এখনও পীড়া দেয় এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগের জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আমি মানপত্র টি লিখেছিলাম এবং তা পাঠ করেছিলাম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন মঞ্জু বিশ্বাস ও ইকবাল হোসেন। এখানে এই অনুষ্ঠানে সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকজন অসামান্য আমেরিকানদের হাতে বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতার নিদর্শন সরূপ ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখকরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে যখন স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয় এবং তা জাতিসংঘে পাঠানো হয়, সেই অনুষ্ঠানের জন্য আমি ’কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি লিখি এবং সেই গানের কপিও তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেই নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পর যে কয়েকটি দেশ সফর করেছিলেন বাংলাদেশ ছিল তার মধ্য একটি। এভাবে একটি জাতি তা যত ছোট হোক বা বড় হোক তার কর্মের মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি দিয়ে পারে। বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার মাটিতে সেই মহান কাজ টি সম্পন্ন করেছিলেন, এজন্য তিনি চিরকাল জাতির বিবেকের ভূমিকা নেয়ার জন্য প্রসংশিত হবেন, স্মরণীয় থাকবেন। সেইদিনের সেই অনুষ্ঠান শেষে তাই মুক্ত বাতাসে গলা ছেড়ে বলে উঠতে পেরেছিলাম,
’আমি এখন মঙ্গলগ্রহের গোলাপি আকাশকে ছুয়ে নিই তৃপ্তির শ্বাস
আমার পায়ের নিচের সোদা মাটি, মুক্ত আকাশ আমাকে পৌছে দেয় বিশ্বময়;
কারণ আমি পেয়েছি আজ স্বাধীন বাংলাদেশ।’
এই স্বাধীনতা, এই মুক্তির অহংকারকে চিরজীবী রাখতে হবে আমাদেরই।

[পুনশ্চঃ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এখন শুধু আমেরকানদেরই নয়, সারা পৃথিবী থেকে এরকম ১০০ জন কে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা আশা করি তা যেন বাস্তবায়িত হয়]
লেখা পূর্ব-প্রকাশিত, যায় যায় দিন, খবর ডট কম)