Sunday, February 3, 2013

জর্জ ক্লিনটন সহসা...


জর্জ ক্লিনটন
আমেরিকার জনজীবনে বিখ্যাতদের  সহসা দেখতে পাওয়া যায় না। এঁদের নিজস্ব বাহনে চলাফেরা, নিজস্ব নিরাপত্তা, নিজস্ব সবকিছুর জন্য নিত্যদিনের জনসমাগমে প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। তারপরও এখানে অদ্ভূত রকমের সৃজনশীল, খ্যাতিমান মানুষদের দেখা যায় হঠাৎ করে কোন নিজস্ব শহরের চেনা জায়গায়। আজ সেরকম একজনের গল্প বলবো।

আমেরিকা নামক বিশাল দেশটির সঙ্গীতের ভান্ডার আমাকে একেবারে অভিভূত করে। এতো বৈচিত্রময় সংগীত আর নিত্য-নতুন নান্দনিকতায় একেবারে বর্ণিল সঙ্গীতের স্বাদ খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য মাঝে মাঝে আমি নিজের কাছে খুব লজ্জিতবোধ করতাম যখন দেখতাম হয়তো কোন এক ছোট্ট শহরের ছোট্ট পানশালায় কেউ গিটার বাজাচ্ছে, অখ্যাত কোন স্থানীয় দরিদ্র গিটারিস্ট; কিন্তু বাজানো শুনলে কিম্বা তাঁর সঙ্গীত বিষয়ক জ্ঞান-গভীরতা দেখলে মনে হবে হায়রে সারা বাংলাদেশেও হয়তো এরকম দুজন গিটারিস্ট পাওয়া যাবে না। একথায় কেউ কাউ তেড়ে আসবেন আমার দিকে জানি। কিন্তু আমি বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের কম গভীরে যাই নি; ধী-শক্তি নিয়ে দীর্ঘ সাধনায় সঙ্গীত কে রপ্ত করার মতো শিল্পীর বড়ই অভাব; বরং কিছুদিন বাজিয়েই টেলিভিশন বা প্রচার মাধ্যমে যাওয়ার জন্য হুমড়ি-খেয়ে-পড়ে-থাকা পারফরমারের সংখ্যাই বেশি। যা হোক, এখনও যা দেখি তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে আসে, কারণ বাংলাদেশকে ভালবাসি, বাংলাদেশ এখনো মন-মননের আবাসভূমি।
সিদ্ধার্ধ'স গেট (Siddhartha's Gate) এর অনুষ্ঠানে

নিজের ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’র মতো ঘরে বসে তবলা বাজানোর চেষ্টা করি। করতে করতে আজকাল আমেরিকান বন্ধুদের সঙ্গে বাজানো শুরু করা। ‘জন ওকিফ’ নামে ক্লাসিক্যাল চেলো বাদক আমার বন্ধু। সঙ্গে আরেকজন গিটারিস্ট নিয়ে আমাদের দল “সিদ্ধার্থের দরজা” বা “Siddhartha’s Gate”। এখন নিয়মিতভাবে আমরা বাজাই শহরের বেশ অভিজাত একটি রেস্টুরেন্টে। এখানে পয়সা-ওয়ালা সঙ্গীত এবং ভোজন রসিকেরা আসেন। আমি সবসময় খুব বিনয় এবং লজ্জার সঙ্গে সবাইকে বলি ‘দেখো আমি কিন্তু তবলাবাদক নই, তোমরা ওস্তাদ জাকির হোসেন কে শুনেছো এই শহরে, তিনি হলেন সত্যিকারের তবলার শিল্পী। আমাকে দিয়ে এই যন্ত্রকে বিচার করো না”। যা হোক, গত ফেব্রুয়ারি ১-২ তারিখ রাতে এরকম সঙ্গীতের আসরে হঠাৎ করে এসে হাজির হলেন গায়ক, গীতিকার, সঙ্গীত প্রযোজক  ‘জর্জ ক্লিনটন’ (George Clinton) জর্জ ক্লিনটন ষাট-সত্তর দশকের সারা জাগানো নতুন ধারার সঙ্গীতের কর্ণধার। ‘ফাঙ্ক’ (funk) মিউজিক নামের যে ধারা তার মুকুটে  ‘সাইকোডেলিক ফাঙ্ক’ ‘পার্লামেন্ট ফাঙ্ক’ নামক দুটি নতুন পালক যোগ করেছেন জর্জ ক্লিনটন। শুধু তাই নয় ‘পার্লামেন্ট’ (Parliament) এবং ‘ফাঙ্কাডেলিক’  (Funkadelic) নামের দুটো ব্যন্ডেরও স্রষ্টা তিনি। তাঁর অনেক বিখ্যাত গান আছে যেগুলো চার্টের এক নম্বরে এসেছে, ‘যেমন ‘এটমিক ডগ’ (Atomic Dog) ‘ওয়ান নেশন আন্ডার এ গ্রুভ’ (One nation under a groove), ডক্টর ফ্রাঙ্কেন্সটাইন ( Dr. Frankenstein)  ইত্যাদি।
জর্জ ক্লিনটন এর স্টেজ পারফরমেন্স
জর্জ ক্লিনটন যে ধারার গান করেছেন তা ছিল একেবারে অনন্য। গানের বাণীতে শাণিত রাজনৈতিক বক্তব্য, তির্যক ব্যঙ্গ, একেবারে রীতিবিরুদ্ধ ধারণা, সর্বোপরী অনন্য প্রকাশভঙ্গিতে স্টেজে গান গাওয়ার গায়কীর জন্য এই ধারার সঙ্গীত নিজস্ব আসন করে নিয়েছিল। যার পুরস্কার স্বরূপ ‘রক এন্ড রোল হল অফ ফেম’ এ অন্তর্ভূক্তি, আরবান আইকন এওয়ার্ড, গ্রামি নমিনেশন জুটেছে জর্জের কপালে।

জর্জ ক্লিনটন কে নিয়ে লিখতে গেলে আস্ত একটি বই লেখাটা তাঁর অবদানের প্রতি সুবিচার হবে। তা যখন করা যাবে না তখন তাঁর লিঙ্কগুলো দিয়ে দেয়াই ভালঃ



একদিনের এই সহসা আগমনে আমাদের প্রজন্মের মধ্যেও তিনি জাগিয়ে গেছেন সঙ্গীতের প্রেরণা, যেমন জুগিয়েছেন গত ছয়-সাত দশক ধরে, সেই প্রেরণা হয়তো বেঁচে থাকবে চিরকাল।
জর্জ ক্লিনটনের সঙ্গে আমি, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৩