Saturday, September 5, 2009

সোয়াইন ফ্লু চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ বাংলাদেশের জন্য কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পদক্ষেপ

[ সেপ্টেম্বর ১, ২০০৯ তারিখে খবর ডট কম-এ সোয়াইন ফ্লু ইনফেকশন নিয়ে উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের কীভাবে চিকিৎসা করা উচিত, বিশেষ করে শিশু বা গর্ভবতী মাদের, তা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। গত সেপ্টেম্বর ২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুই বিশেষজ্ঞ দুই রকমের মতামত দিয়েছেন। একজন বলছেন এক বছরের নিচের শিশুদের এটা চিকিৎসা দেয়া যাবে না, অন্যজন বলছেন যাবে। এই দ্বিমতের মূল কারণ সর্বশেষ নির্দেশনা না জানা। মূলত এই বিতর্ক নিরসনের জন্যেই লেখাটি লিখেছিলাম। এই লেখা পড়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক তরুন চিকিৎসক ইমেইল করেছেন, ফেসবুকে অনুরোধ করেছেন যেন ছোট-বড় সবার চিকিৎসার নির্দেশনা নিয়েই যেন একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা লিখি, তাতে অনেকেই উপকৃত হবেন। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ও ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফ, ডি, এ) ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ভিত্তিতে এই লেখা মূলত চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য লিখলাম। তবে সাধারণ পাঠকেরাও উপকৃত হবেন- সেজান মাহমুদ]

বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইচ ওয়ান এন ওয়ান (H1N1) ভাইরাস বা সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের প্রকোপ দেয়া দিয়েছে। বাংলাদেশেও আজ পর্যন্ত ২৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এখানে মনে রাখতে হবে যে এই ২৪৮ জন বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে চিহি¡ত রোগি। এর বাইরেও অনেক রোগী আছেন একথা ধরে নেয়া অসমীচীন নয়। বাংলাদেশের মতো উষ্ণ জলবায়ু, আদ্রতা বা হিমিডিটি এবং ঘনবসতির জন্য এই ভাইরাস ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে ’হাই রিস্ক’ বা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। এই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন, পাঁচ বছরের নিচের শিশু, গর্ভবতী মা, বয়স্ক ব্যক্তি যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি যাদের কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাঁপানী, হূদরোগ, কিডনীর রোগ, এবং এইডস আছে। বিশেষজ্ঞজনেরা এর মধ্যে ভবিষ্যতবাণী দিয়েছেন যে এই ভাইরাস ধীরে ধীরে পৃথিবীর উত্তর বলয়ে ব্যাপক আকারে আক্রমণ করবে। তবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা দেয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। সরকার ইতোমধ্যে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তার অসম্পূর্ণতা না সম্বনয়হীনতা যেন দ্রুত অতিক্রম করা হয় এই আবেদন করবো এবং এখানে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে দ্বিমতগুলো দেখা দিয়েছে তার উত্তর দেবার চেষ্টা করবো। যেহেতু এই ভাইরাস সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো কাশি, হাঁচি বা ভাইরাসে দূষিত বস্তুর সংস্পর্শে বা আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ বা নাকে সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এর প্রতিরোধের জন্য সাধারণ নিয়মগুলো জনগণের মধ্য ব্যাপকহারে প্রচার করা জরুরি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশি বা হাঁচির সময় নাক ও মুখ ঢেকে রাখা, ঘন ঘন হাত সাবান দিয়ে ধোয়া, বিশেষ করে কাশি বা হাঁচির পর; চোখ, নাক, মুখ হাত দিয়ে না ধরা, অসুস্থ হলে (ফ্লু'র মতো) কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা ঘরে থাকা, খুব জরুরী না হলে বাইরে বের না হওয়া, ঘর-বাড়ির সাধারণ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো স্বল্প সুবিধার দেশে শুধু লক্ষণ থেকেই উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের চিকিৎসা দেয়া জরুরী। প্রথমে এই শ্রেনীর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের চিকিৎসার নীতি কি হবে?



এক. ট্যামিফ্লু (ওসেলটামিভির) শুধু মাত্র এক বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিশুদের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে এক বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকর নয়। যেহেতু এক বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই সোয়াইন ভাইরাস মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে তাই তাদেরকে নিম্নোক্ত চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে বলে অতি জরুরি অনুমোদন দেয়া হয়েছেঃ

  • তিন মাসের কম বয়সী শিশুদের ১২ মিলি গ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য

  • তিন থেকে পাঁচ মাসের শিশুদের ২০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য

  • ছয় থেকে এগারো মাসের শিশুদের ২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য
এখানে মনে রাখতে হবে যে এই শিশুদের চিকিৎসা করতে হবে গভীর পর্যবেক্ষনের সঙ্গে যাতে যে কোন প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে নিচের লক্ষণগুলো দেখলেই জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবেঃ
  • শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস

  • চামড়া নীল হয়ে যাওয়া বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া

  • শিশু যদি যথেষ্ঠ পরিমানে দুধ বা পানীয় পান না করে

  • বার বার বমি করা

  • মাত্রাতিরিক্ত ঘুমানো বা নেতিয়ে পড়া

  • মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে থাকা

  • ফ্লু'র লক্ষণ প্রশমিত হয়ে আবার জোরালো ভাবে জ্বর ও কাশিসহ ফিরে আসা

দুই. আঠারো বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর কমানোর জন্য কোন ভাবেই অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা যাবে না। প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রুফেন দেয়া যেতে পারে।
তিন. গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের অনেক ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে। এ কারণে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা করা জরুরী। যদিও ওসিলটাভির ও জানামিভির এই দুটো ওষুধ গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে কখনও পরীক্ষা করা হয় নি কিন্তু এই দুটো ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকারক নয়। এর মধ্যে ট্যামিফ্লু বা ওসিলটাভিরই বেশি নির্ভরযোগ্য।

চার. এইচ আই ভি তে আক্রান্ত রোগীরা অন্য সাধারণ মানুষের মতোই সমান ঝুকিপূর্ণ। কারণ যদিও এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে কিন্তু সিডি৪ নামক প্রতিরোধের নিয়ামকটি সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে তেমন ভূমিকা রাখে না। তাহলে এরা কেন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ? এর কারণ সোয়াইন ফ্লু থেকে যে অন্য জটিলতাগুলো দেখা দেয় যেমন নিউমোনিয়া, তা ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে, এমন কি জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এজন্য এইচ আই ভি আক্রান্তদের এন্টিভাইরাস ঔষধ দেয়া জরুরী, তার চেয়েও জরুরী এদের অন্য সাধারণ চিকিৎসা ঠিক রাখা, যেমন সিডি৪ নম্বর ২০০ এর ওপরে রাখা, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করানো ও অন্যান্য সহযোগী চিকিৎসা ঠিক রাখা। এক্ষেত্রে ওসিলটাভির ও জানামিভির এই দুটো ঔষুধ ব্যবহার করা যাবে।

পাঁচ. বড়দের ক্ষেত্রে ফ্লু'সহ নিচের লক্ষণগুলো দেখলেই জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবেঃ
  • শ্বাসকষ্ট বা ছোট ছোট শ্বাস প্রশ্বাস

  • বুকে বা পেটে ব্যথা

  • হঠাৎ মাথা ঘুরানো

  • মানসিক বিভ্রান্তি

  • বেশি বেশি বমি হওয়া

  • ফ্লু'র লক্ষণ প্রশমিত হয়ে আবার জোরালো ভাবে জ্বর ও কাশিসহ ফিরে আসা
বড়দের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য ওপাত্ত থেকে নিম্নোক্ত ডোজে চিকিৎসা এমনকি প্রতিষেধমূলক (প্রফাইলেক্সিস) চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। প্রতিষেধমূলক চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে তাদেরকে যারা কোন সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন বা শারীরিকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে প্রথম সংস্পর্শে আসার দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত চিকিৎসা নিম্নোক্ত পরিমানে দিতে হবে। তবে যদি কোন রোগীর রোগের সাতদিন পার হবার পরে সংস্পর্শে আসা-হয় তবে আর প্রতিষেধমূলক (প্রফাইলেক্সিস) চিকিৎসার পয়োজন নেই।


ওষুধের নাম চিকিৎসা
ট্যামিফ্লু বা ওসেলটাভির পরিনত বয়সঃ
৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাপ, দিনে দু’বার পাঁচ দিন

প্রতিষেধমূলক চিকিৎসা
- ৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাপ, দিনে একবার
শিশুঃ এক বছরের বেশি
১৫ কেজি বা কম ওজন
চিকিৎসাঃ ৬০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ - ৩০ মিলিগ্রাম দিনে একবার
১৬-২৩ কেজি
চিকিৎসাঃ ৯০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ -৪৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার
২৪-৪০ কেজি
চিকিৎসাঃ ১২০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ -৬০ মিলিগ্রাম দিনে একবার
>৪০ কেজি
চিকিৎসাঃ ১৫০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ - ৭৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার
জানামিভির পরিনত বয়স
চিকিৎসাঃ দুইবার ৫-মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে দুবার
প্রতিষেধমূলকঃ -দুইবার ৫মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে
টেনে নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে একবার
শিশু সাত বছর বা বেশি
চিকিৎসাঃ দুইবার ৫-মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া
(১০মিলি মোট) দিনে দুইবার

প্রতিষধমূলকঃ দ-৫-মিলিগ্রামশ্বাসের সঙ্গে টেনে
নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে একবার
চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে সব রোগীর জন্য এই ব্যয়বহুল ওষুধের প্রয়োজন নেই। একজন ডাক্তার রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, অন্যান্য রোগের সহাবস্থান, উপসর্গের মাত্রা ইত্যাদি বিবেচনা করে এই চিকিৎসা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেবেন। সোয়াইন ফ্লু চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে একথাও বলা জরুরী যে কোন অবস্থাতেই আতঙ্কিত না হয়ে সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া খুব গুরুর্ত্বপূর্ণ। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্য অনেক যুগের মতো এই সোয়াইন ফ্লু’কেও জয় করা সম্ভব হবে। এই প্রত্রিয়ায় সকলেই সামিল হোন।

সেপ্টেম্বর ০১-০৩

লেখকঃ
সহযোগী অধ্যাপক, জনস্বাস্থ্য
ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথ
ফ্লোরিডা এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটি, ইউ, এস, এ।

অতিরিক্ত তথ্যের জন্য পড়ুনঃ



http://www.fda.gov/downloads/Drugs/DrugSafety/InformationbyDrugClass/UCM153546.pdf










No comments:

Post a Comment