Sunday, February 3, 2013

জর্জ ক্লিনটন সহসা...


জর্জ ক্লিনটন
আমেরিকার জনজীবনে বিখ্যাতদের  সহসা দেখতে পাওয়া যায় না। এঁদের নিজস্ব বাহনে চলাফেরা, নিজস্ব নিরাপত্তা, নিজস্ব সবকিছুর জন্য নিত্যদিনের জনসমাগমে প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। তারপরও এখানে অদ্ভূত রকমের সৃজনশীল, খ্যাতিমান মানুষদের দেখা যায় হঠাৎ করে কোন নিজস্ব শহরের চেনা জায়গায়। আজ সেরকম একজনের গল্প বলবো।

আমেরিকা নামক বিশাল দেশটির সঙ্গীতের ভান্ডার আমাকে একেবারে অভিভূত করে। এতো বৈচিত্রময় সংগীত আর নিত্য-নতুন নান্দনিকতায় একেবারে বর্ণিল সঙ্গীতের স্বাদ খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য মাঝে মাঝে আমি নিজের কাছে খুব লজ্জিতবোধ করতাম যখন দেখতাম হয়তো কোন এক ছোট্ট শহরের ছোট্ট পানশালায় কেউ গিটার বাজাচ্ছে, অখ্যাত কোন স্থানীয় দরিদ্র গিটারিস্ট; কিন্তু বাজানো শুনলে কিম্বা তাঁর সঙ্গীত বিষয়ক জ্ঞান-গভীরতা দেখলে মনে হবে হায়রে সারা বাংলাদেশেও হয়তো এরকম দুজন গিটারিস্ট পাওয়া যাবে না। একথায় কেউ কাউ তেড়ে আসবেন আমার দিকে জানি। কিন্তু আমি বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের কম গভীরে যাই নি; ধী-শক্তি নিয়ে দীর্ঘ সাধনায় সঙ্গীত কে রপ্ত করার মতো শিল্পীর বড়ই অভাব; বরং কিছুদিন বাজিয়েই টেলিভিশন বা প্রচার মাধ্যমে যাওয়ার জন্য হুমড়ি-খেয়ে-পড়ে-থাকা পারফরমারের সংখ্যাই বেশি। যা হোক, এখনও যা দেখি তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে আসে, কারণ বাংলাদেশকে ভালবাসি, বাংলাদেশ এখনো মন-মননের আবাসভূমি।
সিদ্ধার্ধ'স গেট (Siddhartha's Gate) এর অনুষ্ঠানে

নিজের ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’র মতো ঘরে বসে তবলা বাজানোর চেষ্টা করি। করতে করতে আজকাল আমেরিকান বন্ধুদের সঙ্গে বাজানো শুরু করা। ‘জন ওকিফ’ নামে ক্লাসিক্যাল চেলো বাদক আমার বন্ধু। সঙ্গে আরেকজন গিটারিস্ট নিয়ে আমাদের দল “সিদ্ধার্থের দরজা” বা “Siddhartha’s Gate”। এখন নিয়মিতভাবে আমরা বাজাই শহরের বেশ অভিজাত একটি রেস্টুরেন্টে। এখানে পয়সা-ওয়ালা সঙ্গীত এবং ভোজন রসিকেরা আসেন। আমি সবসময় খুব বিনয় এবং লজ্জার সঙ্গে সবাইকে বলি ‘দেখো আমি কিন্তু তবলাবাদক নই, তোমরা ওস্তাদ জাকির হোসেন কে শুনেছো এই শহরে, তিনি হলেন সত্যিকারের তবলার শিল্পী। আমাকে দিয়ে এই যন্ত্রকে বিচার করো না”। যা হোক, গত ফেব্রুয়ারি ১-২ তারিখ রাতে এরকম সঙ্গীতের আসরে হঠাৎ করে এসে হাজির হলেন গায়ক, গীতিকার, সঙ্গীত প্রযোজক  ‘জর্জ ক্লিনটন’ (George Clinton) জর্জ ক্লিনটন ষাট-সত্তর দশকের সারা জাগানো নতুন ধারার সঙ্গীতের কর্ণধার। ‘ফাঙ্ক’ (funk) মিউজিক নামের যে ধারা তার মুকুটে  ‘সাইকোডেলিক ফাঙ্ক’ ‘পার্লামেন্ট ফাঙ্ক’ নামক দুটি নতুন পালক যোগ করেছেন জর্জ ক্লিনটন। শুধু তাই নয় ‘পার্লামেন্ট’ (Parliament) এবং ‘ফাঙ্কাডেলিক’  (Funkadelic) নামের দুটো ব্যন্ডেরও স্রষ্টা তিনি। তাঁর অনেক বিখ্যাত গান আছে যেগুলো চার্টের এক নম্বরে এসেছে, ‘যেমন ‘এটমিক ডগ’ (Atomic Dog) ‘ওয়ান নেশন আন্ডার এ গ্রুভ’ (One nation under a groove), ডক্টর ফ্রাঙ্কেন্সটাইন ( Dr. Frankenstein)  ইত্যাদি।
জর্জ ক্লিনটন এর স্টেজ পারফরমেন্স
জর্জ ক্লিনটন যে ধারার গান করেছেন তা ছিল একেবারে অনন্য। গানের বাণীতে শাণিত রাজনৈতিক বক্তব্য, তির্যক ব্যঙ্গ, একেবারে রীতিবিরুদ্ধ ধারণা, সর্বোপরী অনন্য প্রকাশভঙ্গিতে স্টেজে গান গাওয়ার গায়কীর জন্য এই ধারার সঙ্গীত নিজস্ব আসন করে নিয়েছিল। যার পুরস্কার স্বরূপ ‘রক এন্ড রোল হল অফ ফেম’ এ অন্তর্ভূক্তি, আরবান আইকন এওয়ার্ড, গ্রামি নমিনেশন জুটেছে জর্জের কপালে।

জর্জ ক্লিনটন কে নিয়ে লিখতে গেলে আস্ত একটি বই লেখাটা তাঁর অবদানের প্রতি সুবিচার হবে। তা যখন করা যাবে না তখন তাঁর লিঙ্কগুলো দিয়ে দেয়াই ভালঃ



একদিনের এই সহসা আগমনে আমাদের প্রজন্মের মধ্যেও তিনি জাগিয়ে গেছেন সঙ্গীতের প্রেরণা, যেমন জুগিয়েছেন গত ছয়-সাত দশক ধরে, সেই প্রেরণা হয়তো বেঁচে থাকবে চিরকাল।
জর্জ ক্লিনটনের সঙ্গে আমি, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৩

Friday, May 18, 2012

‘দেয়াল’ কে উপেক্ষা করাই শ্রেয়তর/ সেজান মাহমুদ
এই মুহূর্তে বোধকরি সবচেয়ে বড় মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কাজ হলো হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা সম্পর্কে খুব বেশি নেতিবাচক কিম্বা  খুব বেশি আক্রমণাত্নক সমালোচনা করা। একাধারে তাঁর অসুস্থতা, অন্যদিকে তাঁর প্রতি লেখক হিসাবে আস্থা-দাবি, আশা-আশাহতের দ্বন্দ্ব। তারওপরে আজকাল সময়ের এতো সংকুলান যে যা আমাকে বুদ্ধিবৃত্তি বা হৃদয়বৃত্তিতে সন্তুষ্ট বা তৃপ্ত করে না তার প্রতি কোন মনোযোগ দিতে চাই না। হুমায়ূন আহমদ এর আজকালকার লেখাগুলো সেই মনোযোগ না পাওয়ার দলের। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালবাসা নিয়ে অনেক লিখেছি আগে। সেগুলো অক্ষুন্ন রেখেই আমার এই মন্তব্য। সম্প্রতি ‘দেয়াল’ নামের একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখেছেন তিনি। পৃথিবীর যাবতীয় তত্ত্ব থেকে বিশ্লেষণ করে ‘দেয়াল’ কে উপন্যাস হিসাবে সমালোচনা করা যায়, করতে পারি। কিন্তু ততোটা মনোযোগ দেবার আগেই এই উপন্যাস সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম এর আলোচনা, প্রকাশিত দুই টি পর্ব আর বিভিন্ন মন্তব্য থেকে, তাই-ই যথেষ্ট এই উপন্যাসের ইতিহাস চেতনা, সত্যতার প্রতি নিষ্ঠা, এমনকি লেখকের দৃষ্টভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলার। আর এই প্রশ্ন তুলতে গিয়ে একটু আক্রমণাত্নক না হয়েও উপায় নেই, তা রবং বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্যের প্রতি মমত্ববোধের জন্যেই জরুরী। এটা বলা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলেই মনে করি।

প্রথমতঃ ‘দেয়াল’ নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা বা সরকারী আইনী আরোপ আমি তার বিপক্ষে। বহুবার এই মত প্রকাশ করেছি যে আমি লেখকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে যদি সরকার লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোন তথ্য পালটে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে থাকেন তাহলে তা ভিন্ন কথা। এক্ষেত্রে আবারো বলবো আদালতের রায় দিয়ে যেন লেখকের লেখা প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা না হয়।

দ্বিতীয়তঃ ইতিহাস ভিত্তিক শিল্প রচনায় লেখকের স্বাধীনতা কতটুকু, বা লেখকের নৈতিক কোন দায় আছে কি না এ প্রশ্ন করা অসংগত কিছু নয় , আবার এর উত্তরও সাহিত্য-সমালোচনার ইতিহাস থেকে খুঁজে নেয়া যায় সহজেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইতিহাস সবসময়ই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। হয়তো স্পর্শকাতর না হলে তা ইতিহাসই হয় না। তাই এই স্পর্শকাতরতা বিচার করতে ইতিহাস এর সময়কাল, অতিক্রান্তকাল, সত্যতার প্রতি ন্যায়নিষ্ঠতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে করাই সংগত। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাম্প্রতিক ইতিহাস কে বেছে নিয়েছেন। ইতিহাসের কাছে সাইত্রিশ বছর একেবারেই কিছু না। অন্যদিকে যে বিষয়কে বেছে নিয়েছেন তা বোধকরি জাতির জন্য সবচেয়ে কলঙ্কের, সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এখানে সব সময় মনে রাখা দরকার যে ‘ইতিহাসের সত্য আর শিল্পের সত্য এক নয়’। এই সত্য অর্থ কিন্ত আবার শুধু তথ্য নয়। সত্য হতে পারে ইতিহাসের পূর্ণনির্মাণ, ইতিহাসের অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থকে ডিসাইফার করা, হতে পারে ইতিহাসের ডিকন্সট্রাকশন। যতোদূর জানতে পারছি, কিম্বা এর আগেও হুমায়ূন আহমেদ এর ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ পড়ে মনে হয় না এগুলোর কোনকিছুর চেষ্টা করা হয়েছে কথিত ‘দেয়াল’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের প্রেস-কপি ওপর ভিত্তি করে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম আলোচানা লিখেছেন। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, নিজেও গল্পকার, সমালোচক, ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে হূমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাসের প্রশংসা করেছেন, শুধু ‘দেয়াল’ কেই নয়, ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ কেও একই প্রশংসার উচ্ছাসে ভরিয়েছেন। তাঁর ভাষায় ‘এই উপন্যাসে তিনি (হুমায়ূন আহমেদ) কোনো ইতিহাসবিদের জায়গা নেননি, যদিও একজন ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্যনির্ভরতা তিনি বজায় রেখেছেন।’

এখন আদালতের আদেশ ও অন্যান্য আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারছি আসলে হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসবিদের মতো বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্য-নির্ভরতা বজায় রাখেন নি। অন্তত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এর ব্যত্যয় দেখা গিয়েছ। একটি শেখ রাসেলের মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনায়, অন্যটি এই পটভূমির খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চরিত্র ‘খন্দকার মোস্তাক আহমেদ’ এর ভূমিকায়। যদিও খুনীদের প্রতি একধরণের মমত্ববোধ তৈরির ‘ভিউ পয়েন্ট’ বা দৃষ্টিভঙ্গিও  প্রকাশ পেয়েছে এমনটি জানা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আত্মস্বীকৃত খুনিদের অন্যতম মেজর ফারুক যুদ্ধের শেষ দিকে এসে পক্ষ নিলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার সময়-সুযোগ পাননি। কিন্তু তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে দিয়ে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলা যায়। আমি যেহেতু পুরো উপন্যাটি পড়তে পারি নি তাই উপন্যাসের সার্থকতা ইত্যাদি আলোচনা না করে একটি ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস হিসাবে ‘দেয়াল’ এর ইতিহাসের তথ্যের প্রতি সততা, দায়বদ্ধতা এবং সাহিত্য হিসাবে পরিনতি কী হতে পারে তার দিকে অল্প আলোক প্রক্ষেপণ করবো। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের ইংরেজি সাহিত্য, সাহিত্য তত্ত্ব এবং সাহিত্য ইতিহাসে ইতিহাস-নির্ভর সাহিত্য নিয়ে জ্ঞানের প্রতি আমার কোন সংশয় নেই। আমি বরং প্রশ্নাকারে তাঁকেও জিগ্যেস করতে পারি কেন তিনি দেয়াল কে বস্তনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ তথ্য-নির্ভর বলেছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস, নাটক বা এপিক কাব্য নিয়ে যারা বিস্তর লিখেছেন তাঁদের মধ্যে জার্মান লেখক, জীববিজ্ঞানী গ্যোটে (Goethe), দার্শনিক হেগেল, রুশ কবি পুশকিন এবং সাহিত্য সমালোচক বেলিনস্কি বোধকরি একই ধরণের তাত্ত্বিক ধারণা পোষণ করতেন, তা হলো,
“..The writer’s historical fidelity consists in the faithful artistic reproduction of the great collisions, the great crises and turning points of history.”

এই শিল্পিত বিনির্মাণে লেখক বা শিল্পীর অপরিসীম স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু যখন শিল্পকর্মটি বিচার করা হয় তখন অতিক্রান্ত কাল খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিরাজুদ্দৌলা নাটকে ইতিহাসের চরিত্রগুলো রূপায়ন করতে গিয়ে মীর জাফর কে এতোটাই বেঈমান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যে ‘মীর জাফর’ এখন বেঈমানী বা কৃতঘ্নতার সমার্থক। এখন একজন লেখক দাবি জানিয়েছেন যে ইতিহাসে আসলে মীরজাফর এর চেয়ে মোহন লালের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল বেশি কিন্তু নাটকে দ্বিজেন্দ্র লাল রায় তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছিলেন। আমি ঘটনার সত্যতা জানি না, বা এই আলোচনায় জানারও প্রয়োজন নেই। যদি ঘটনাটা সত্যিও হয় এখন এই দীর্ঘ অতিক্রান্তকালে তা আর ইতিহাসের কোন ক্ষতি করবে না, বর্তমান বাস্তবতারও কোন ক্ষতি করবে না। বরং এই নতুন তথ্য হিসাবে ইতিহাসে অন্তর্ভূক্তি পেলেও নাটক হিসাবে সিরাজুদ্দৌলা সেই আগের অবস্থানেই থাকবে এবং মীরজাফর সেই মীরজাফরই থেকে যাবেন। কিন্তু উপন্যাস ‘দেয়াল’ এমন একটি সময়ের যা থেকে অতিক্রান্ত কাল মাত্র সাইত্রিশ বছর। সমসাময়িক ঘটনাভিত্তিক রাজনৈতিক উপন্যাস, বা ইতিহাস-নির্ভর লেখায় এই দায়বদ্ধতার অন্য মাত্রা আছে। আমার কাছে শেখ রাসেলের মৃত্যু দৃশ্যটির পরিবর্তনটি এমন কোন গুরুতর বিষয় নয়, বরং হয়তো ঘটনাকে আরো নাটকীয় এবং মর্মস্পর্শী করে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খন্দকার মোস্তাক আহমেদ এর বঙ্গবন্ধু কে হত্যার ঘটনা থেকে দূরে রাখা বা অনবহিত দেখানোর অনেক বড় রাজনৈতিক মাত্রিকতা আছে। সেই মাত্রিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং তদপরবর্তী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মকান্ডের আইনী দিকের সঙ্গেও জড়িত। বিশেষ করে দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিচার করার প্রস্তুতি চলছে, এবং কালক্রমে হয়তো বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারও পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে, এমতবস্থায় শুধু উপন্যাস রচনার নামে ইতিহাস নিয়ে এই হঠকারীতা প্রশ্ন সাপেক্ষ বৈ কি।অন্যদিকে ইতিহাসের উপাদানকে শিল্পে ব্যবহার এবং রূপান্তরের যে আঙ্গিকগত নিরিক্ষা সারা পৃথিবী জুড়ে দেখা যায়, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে ঋদ্ধ, সংহত, গবেষকের নিষ্ঠা নিয়ে লেখার প্রবনতাকেও লক্ষ্য করা যায় না।
 এই প্রসঙ্গে আমেরিকার পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, আমার বন্ধু বলেও যাকে দাবি করতে পারি সেই রিক ব্র্যাগ এর কথা স্মরণ করি। আমি ‘রিক ব্র্যাগঃ জীবন ছোঁয়া এক গল্পের রূপকার’ শিরোনামে লেখা লিখেছিলাম তাঁকে নিয়ে। “রিক ব্র্যাগ (Rick Bragg)। রিক শুধু একজন সাংবাদিকই নন, একজন তুখোর গল্পকারও। কিন্তু তিনি গল্প লেখেন সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে, সরেজমিনে তদন্তের পর। নিউ ইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য তিনি ইতোমধ্যেই পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার (Pulitzer Prize), আমেরিকার সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকমন্ডলী প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার, আমেরিকান সোসাইটি অব নিউজ পেপারস এডিটর’স ডিসন্টিংগুইশড রাইটিং এওয়ার্ড পেয়েছেন দু’দুবার। এছাড়াও চল্লিশটি ছোট-বড় সাংবাদিকতার পুরস্কার তার ঝুলিতে। সুতরাং রিক যে একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি রিক ব্রাগ আলোচিত হয়েছেন আবার, যখন তিনি ইরাক যুদ্ধে আমেরিকান মহিলা যুদ্ধবন্দী বা প্রিজনার অব ওয়ার (Prisoner of War) জেসিকা লিঞ্চ (Jessica Lynch)-এর জীবনীভিত্তিক একটি বই লেখার জন্য মোটা সন্মানীর (3 million dollar) বিনিময়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।“ যারা জানেন বা জানেন না তাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য বলি, জেসিকা লিঞ্চ ছিলেন আমেরিকার একজন সাধারণ সৈন্য। ইরাকের যুদ্ধের সময় জেসিকার সঙ্গীদল মরুভূমির মধ্যে ইরাকী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তাঁর সঙ্গের চারজন সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। জেসিকা কে যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধরে নিয়ে যায় সাদ্দাম বাহিনি। সেখানকার হাসপাতাল থেকে পরে তাঁকে আমেরিকান বাহিনি উদ্ধার করে নিয়ে আসে। দেশে ফেরার পরে বুশ সরকার জেসিকার বীরত্ব, আত্নত্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক মিডিয়া প্রচার করতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে রিক ব্র্যাগ জেসিকার জীবন ভিত্তিক গ্রন্থ রচনার জন্য চুক্তিভূক্ত হন। এখানে লক্ষ্যনীয় যে রিক ব্র্যাগ সব সময় সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা লিখেছেন। তাঁর নিষ্ঠার জন্য, অসাধারণ গল্প বলার জন্য এবং বিশ্বাসযগ্যতার জন্য তিনি ছিলেন একেবারে প্রশ্নাতীতভাবে সম্মানীয়।

রিক ব্র্যাগ লিখেছেন সাউথ ক্যারোলিনার সুসান স্মিথের কথা। মাত্র তেইশ বছর বয়েসের এই মা তার দুই ছেলে, তিন বছরের মাইকেল এবং চোদ্দ মাসের আলেকজান্ডার স্মিথ কে গাড়িতে রেখে নদীতে ডুবিয়ে দেন গাড়িটি। তারপর পুলিশকে খবর দেন এই বলে যে এক কালো ষন্ডামার্কা লোক তার গাড়িটি হাইজ্যাক করেছে তার দুই ছেলেসহ। পুলিশি অনুসন্দ্ধানে যখন জানা গেল আসলে এই মা-ই তার দুই ছেলের খুনী তখন সাড়া আমেরিকায় হইচই পরে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সকলের চোখে এই সুসান স্মিথ একজন খুনী, সামাজবিরোধী ব্যক্তি। রিক তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ধারাবাহিক লিখলেন এই সুসান স্মিথের ওপর। তার লেখায় বের হয়ে এলো তেই বছরের এই মায়ের করুন কাহিনী। সেই ছোটবেলা থেকে সৎ বাবার যৌন অত্যাচার, স্বামীর নির্যাতন আর অভাবের পেষণে কি করে এই তরুণী হয়ে ওঠে এক মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। রিকের লেখায় বের হয়ে আসে সভ্য সমাজের অন্তরালে জেগে ওঠা দুষ্ট ক্ষতের মতো গ্লানিকর ইতিহাস। আইনের বিচারে দোষী এই তরুনী, সমাজের চোখে নৃশংস এই মা হয়ে ওঠেন এক ট্রাজিক গল্পের নায়িকা।

আমি রিক ব্র্যাগ কে জেসিকা লিঞ্চ কে নিয়ে লেখা বই প্রসঙ্গে জিগ্যেস করেছিলাম এভাবে,

‘তোমার বাবা ছিলেন কর্মবিমূখ মদ্যপ, মাতাল, আমার বাবাও ছিলেন কর্মবিমূখ, ফুটবল-পাগল বা ফুটবলের মাতাল। তুমি এদেশের স্বনামখ্যাত লেখক, আমিও আমার ভাষার ক্ষুদ্র লেখক। এবার বলো একজন লেখক যখন জনপ্রিয় হন, তখন সবচেয়ে বড় কম্প্রোমাইজ বা আপোষ তাকে কিসের সাথে করতে হতে পারে?'

রিক কিছুক্ষণ একেবারে চুপ থাকার পর বললেন, তুমি যদি আমাকে সোজা প্রশ্নটি করতে তাহলে আমিও সহজে উত্তর দিতে পারতাম। আমি জানি তোমার ভূমিকাটি অহেতুক নয়। আমি জেসিকা লিঞ্চ-এর ওপর বই লিখতে সম্মত হয়েছি, জেসিকা আমাদেরই একজন। যদি এই লেখাটিতে আমি আমাদের মানুষের গল্প বলতে না পারি তাহলে এটাই হবে আমার ব্যর্থতা, এটাই হবে আমার কম্প্রোমাইজ বা আপোষ। আমি খুশি হলাম এই ভেবে যে রিক আমার ঈঙ্গিতটা ধরতে পেরেছেন এবং সৎ ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। রিক এতোদিন লিখে এসেছেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কথা, যে কারনে তার আজ এতো খ্যাতি। আমেরিকার কোন যুদ্ধ-বন্দীকে নিয়ে লিখতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই জেসিকা লিঞ্চের ঘটনার সঙ্গে রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোই জড়িত। তাই রিকের এই অকপট স্বীকারোক্তিতে তার প্রতি আমার মুগ্ধতা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

এবার লক্ষ করুন প্রকৃতপক্ষে কি ঘটলো এই জেসিকা লিঞ্চ কে নিয়ে। বইটি বের হবার মাত্র কিছুদিন আগে জেসিকা লিঞ্চ টিভি সাক্ষাতকারে জানালেন তাঁকে নিয়ে যে বীরত্বের কাহিনি প্রচার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তিনি আসলে বীরের মতো যুদ্ধ তো করেনই নি, রবং যখন তাঁর দল আক্রান্ত হয়েছিল তিনি ভয়ে ট্রাকের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এবং পাল্টা গুলি করতে ভুলে গিয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর চার সঙ্গীর মৃত্যু হয়। তিনি কোনভাবে বীরের খেতাব বা মিথ্যা প্রাপ্তির কথা জীবনের এই সন্ধিক্ষণে এসে গ্রহণ করতে পারবেন না। এখন লেখক হিসাবে রিক ব্র্যাগ এর কি দায়িত্ব? তিনি তো আর ইতিহাসের বই লিখছিলেন না, ইতিহাস নির্ভর লেখা লিখছিলেন। তিনি কি এই মিথ্যাচার গ্রহণ করতে পারতেন না? কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং এই জেসিকা লিঞ্চের সেই দারিদ্রপীড়িত ছোট বেলা, সত্যতার প্রতি অনুরাগ, কষ্টকর জীবন-যাপন তুলে আনলেন তাঁর লেখায়, ‘আই এয়্যাম এ সোলজার টু’ গ্রন্থে। তাঁর পরও শুধু এইরকম মিথ্যাচার এর গল্প লেখার কারণে পাঠকের কাছে বিরাট আকারের খেসারত দিতে হলো রিক ব্র্যাগ কে, তিনি প্রায় প্রত্যাখ্যাত হলেন পাঠকের কাছে, সমালোচকের কাছে।

অন্যদিকে একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লেখার জন্য যে গবেষণা, তথ্যের বিশ্লেষণ, নানা রকমের প্রেক্ষিতকে পর্যলোচনা করে সত্যের সার অংশটুকু তুলে আনার জন্য যে পরিশ্রম এবং ধী-শক্তি তার কতটুকু ব্যয় হয়েছে এই উপন্যাসে এরকম প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেমন, বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে সে সময়ের বেশিরভাগ লেখা্তেই কোন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হুমায়ূন আহমেদ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখার সূত্র ধরে যে সব তথ্য দিয়েছেন তা তিনি যাচাই করেন নি যেমন আমরা জানি, তেমনি এও জানি যে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস কীভাবে সামরিক জান্তার যোগসাজশে অনেক বানোয়াট লেখা লিখেছেন। কারো কারো লেখায় এমন কি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেও এরকম ধারণা উঠে এসেছে যে একদল রাগী, তরুন সামরিক অফিসার শেখ মুজিব কে হত্যা করছে। এই ধরণের সরলীকরণ শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তিধরদের আড়াল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। না হলে এই খুনীরা কী করে সেই সময়ের আরেক ডিক্টেটর গাদ্দাফির কাছে আশ্রয় পেয়েছিল? এদের বিচার করতে বরাবরই  (এতোদিন) পরাশক্তির বাধাই বা এসেছে কেন? গাদ্দাফি কাদের সৃষ্ট একনায়ক, এধরণের প্রশ্নের মধ্যে দিয়েও অনেক সত্য বেরিয়ে আসে। সাহিত্যিকের কাজ প্রকৃতপক্ষে একজন ইতিহাসবিদের চেয়েও কঠিন! তাই এই উপন্যাস পড়ে পাঠক বরং জানবেন খন্দকার মোস্তাক শেখ মুজিব হত্যার কিছু জানতেন না, কর্ণেল ফারুক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, দরদী মনের পীর বংশীয় মানুষ। সুতরাং তাঁদের কৃত-কর্ম নিয়ে একধরনের নরোম মনোভাব তৈরি হতেই পারে।

হুমায়ূন আহমেদ ভাগ্যবান যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষা-বঞ্চিত, যারা শিক্ষিত তাদের মধ্যেও আবার বড় অংশ কুশিক্ষিত, অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শে অন্ধ। সাহিত্য সমালোকদের মধ্যেও নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তা না হলে এই ইতিহাস ভিত্তিক রচনায় যদি সত্যি প্রমাণিত হয় যে মোস্তাক আহমেদ আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার সব কিছু জানতেন (আমার জানা যতো তথ্যভিত্তিক গ্রন্থ আছে তাতে মনে হয় মোস্তাক আহমেদ শুধু জানতেনই না, হয়তো জড়িতও ছিলেন) তাহলে এই বিকৃতি তা যতোই উপন্যাস সৃষ্টির নামে হোক না কেন, তার দায়ভার হুমায়ূন আহমেদ কেই নিতে হবে। শিল্পের সত্য আর ইতিহাসের সত্য এক না হলেও শিল্পের প্রতি যে নিখাদ নিষ্ঠতা দেখাতে হয় তার অভাবের জন্য তাঁকেও হয়তো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে একদিন। হয়তো বিকৃতির অভিযোগে এই বই আস্তাকুঁড়ে ছূড়তেও দ্বিধা করবে না কেউ। আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা এই ভিউপয়েন্ট থেকে লাভবান হবেন তাঁরা মাথায় তুলে নাচবেন ঠিকই। এখন প্রশ্ন হলো এই দ্বিধা-বিভক্ত জাতিগত মানসে হুমায়ূন আহমেদ আরেকটি বিভক্তির বিষ ইঞ্জেকট করে যাবেন নাকি সবশেষে এদেশের ইতিহাসের এক ট্রাজিক নায়কের মর্মান্তিক পরিনতি সকল কে ন্যুব্জ, অশ্রুসিক্ত করবে? পূর্ববর্তী কর্মের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর যে মানসের পরিচয় পাই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাঁর কাজে সেটা আশা তো করা যাচ্ছেই না, বরং ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক একধরণের সূক্ষ্ণভাবে মুক্তযুদ্ধবিরোধীদের প্রতি নরোম জায়গা তৈরি করে দিচ্ছেন। এই সংশয়, সেই পরিনতির দিকে তাকিয়ে, লেখকের স্বাধীনতার দিকে তাকিয়ে মনে হয় ‘দেয়াল’ কে  উপেক্ষা করাই শ্রেয়তর!

Sunday, January 22, 2012

হার্ভার্ডের স্মৃতিঃ অমর্ত্য সেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদানকারী কয়েকজন অসামান্য আমেরিকান


১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার কাছে একটি নিমন্ত্রণপত্র এলো; তাতে লেখা, "Harvard Center for Population and Development Studies invites you to a Birthday party for Bangladesh".

আমি তখন আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশীপ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়ালেখা করছি। এই ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার কিছু নেই। আমেরিকার কেমবৃজ ও বস্টন শহর জুড়ে এই ইনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, পৃথিবী-জোড়া সুখ্যাতি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অন্যতম প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। সর্বমোট তেতাল্লিশজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী-শিক্ষক আছেন এখানে, এবং প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছে। কেমবৃজ শহরে হার্ভার্ড স্কয়ারে কফি শপগুলোতে ঢুকতে গেলে কোন নোবেল

লরিয়েটের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে- এরকম কৌতুকও চালু আছে। এই ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট রিং বা আংটির বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এভাবে-
‘প্রতি চারজন আমেরিকানের একটি করে বাড়ি আছে,
প্রতি একশজনের একটি করে জেট,
প্রতি ২৪০ জনের একটি করে ইয়ট-
কিন্তু প্রতি ১৭ হাজার আকেরিকানের একজন মাত্র এই আংটিটি পরতে পারেন।’

সেই হার্ভার্ডের ক্যাম্পাসে পালিত হবে বাংলাদেশের পচিশতম জন্মবার্ষিকী! তাতে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়নের ওপর আলোচনা ও নৈশভোজ। আলোচনা অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু নৈশভোজ শুধু আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। আমার কাছে এই রহস্যটি এখনও অজানা যে, আমি কী করে সেই নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম! কেন এটি বিষ্ময়কর তা আমন্ত্রিত অতিথিদের নাম জানলেই পরিস্কার হয়ে যাবে। প্রতিটি চেয়ারে আমন্ত্রিত অথিতিদের নাম শেষ নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে সাজানো। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথিবৃন্দ। আমার অফিসিয়াল নামের প্রথম অক্ষর ’আর’। সেকারনেই আমার ডান পাশে বসেছেন অমর্ত্য সেন, বাম পাশে বস্টন ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রফেসর দম্পত্তি হান্না ও গুস্তাফ পাপানেক। অমর্ত্য সেন তখন নোবেল পুরস্কার না পেলেও ইউনিভার্সিটি চত্বরে সবার মুখে মুখে শোনা যায় তাঁর নাম, একারনে যে নোবেল পাওয়া তাঁর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি হেলথ পলিসি বিষয়ে পড়ার সুবাদে তাঁর অর্থনীতি বিষয়ে লেখা এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের জন্যে তাঁর দর্শন বিষয়ক লেখাগুলোর সঙ্গে পরিচিত। কখনো কেমবৃজ ক্যাম্পাসে তাঁর ক্লাসে বসে শুনেছি ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্স নিয়ে তাঁর তুখোর ও রসালো বক্তব্য। রসালো বলার কারণ হলো, তিনি অসাধারণ বাকপটু এবং মারাত্নক কথাগুলো রসিকতা করে বলতে পারেন। যেমন এই অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে যখন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান এবং ড. আবু আবদুল্লাহ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ভীষণ আশাবাদী বক্তব্য রাখলেন, অমর্ত্য সেন শুরুতেই বাঙালির অতিরঞ্জন প্রিয়তার প্রতি ইঙ্গিত করে রামমোহন রায়ের গানটি শুনিয়ে দিলেনঃ
’মনে করো শেষের সেদিন ভয়ংকর
অন্য বাক্য কবে কিছু তুমিই রবে নিরুত্তর।’

অর্থাৎ একমাত্র মৃত্যু হলেই আমরা মুখ বন্ধ রাখি। যা হোক, সেই অমর্ত্য সেন পাশে বসেছেন। আমি অনেকটা আনন্দে দিশেহারা। নৈশভোজে আরও এসেছেন হার্ভার্ডের প্রফেসর লিংকন চেন, মার্টি চেন, রিচার্ড ক্যাশ, ওমর রহমান (যিনি বর্তমানে বাংলাদেশে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য, এবং আমার একাডেমিক আদর্শ), এম আই টি’র প্রফেসর রিচার্ড তাব্যুর। আরও এসেছেন ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্লড রিপোর্টের সাংবাদিক এমিলি ম্যাকফার কোহার। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ডক্টর রেহমান সোবহান, এবং ডক্টর আবু আবদুল্লাহ। এখানে আমন্ত্রিত আমেরিকান নাগরিকদের সবাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোন ভাবে অবদান রেখেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকান সরকারের ভূমিকা সম্পূর্ণ বিরোধী হওয়া সত্বেও এই দেশের অনেক বিবেকবান, মহৎ নাগরিক নিজস্ব তাগিদে অসামান্য অবদান রেখেছেন। মানবতার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানানোর এই অবদানগুলোর কথা বলতে গেলেই ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত পন্ডিত রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর গানটির কথা চলে আসে সবাগ্রে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমেরিকাতে প্রথম কনসার্টটি করেছিলেন ওস্তাদ আকবর আলী খান, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে মে মাসের ২৮ তারিখে। তারপরই শিল্পী জোন বেজ দুটি কনসার্ট করেন- একটি স্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাসে, অন্যটি মিশিগান ইউনিভার্সিটির অ্যান আরবর ক্যাম্পাসে। দুটি ক্যাম্পাসেই ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো লোক সংখ্যা ছিল।

এই শিল্পী গেয়েছিলেন সেই গানটিঃ
'When the sun shines in the West
Die a million people in Bangladesh"

এই গানটির কথা আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। সঙ্গীতের বিশ্বজনীন আবেদন নিয়ে এ শিল্পীরা আমাদের আবেগ-অনুভূতির মর্মমূলে নাড়া দিয়েছিলেন বলেই মনে হয় এ ঘটনাগুলো আমাদের সবার স্মৃতিতে অমর হয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের অনেকেই ছিলেন যাদের এই শিল্পের ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু অসামান্য হৃদয়বোধ, মানবিক উৎকর্ষতা নিয়ে তারা সমর্থন জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। সেই সমর্থনের ভাষাও কখনো কখনো হয়ে উঠেছিল শিল্পের সমতূল্য। আজকের অনুষ্ঠানে তাদের অনেকেই উপস্থিত।
পাপানেক দম্পত্তি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ করেছেন। বস্টন ইউনিভার্সিটির বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই পাকিস্তানের বাধা দেয়ার কারণে দেশ থেকে টাকা পয়সা পাচ্ছিলেন না। এই দম্পতি নিজেদের বেতনসহ আরও অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুস্তাফ পাপানেক অন্য দুজন লেখকের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি পজিশন পেপার লিখেছিলেন। তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ এই দম্পতির ঘটনা ছাপা হবার পর এই সহৃদয় যুগল চাকরী হারান। এঁরা দীর্ঘ সময় হার্ভার্ডের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। এই হান্না পাপানেক অনুষ্ঠানের শুরুতেই আক্ষেপ করে বললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র পচিশ বছর পরেই বাংলাদেশের তরুন প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলে তিনি হতাশ হয়েছেন; তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন আগ্রহই নেই। তিনি এই তরুন প্রজন্মের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তনয় জয়ের কথাও উল্লেখ করলেন।

আমি ততোক্ষণে এই অষ্ঠবজ্র সম্মেলনের ধাক্কা কিছুটা সামলে উঠেছি। হান্না পাপানেকের এই কথার পর আমি হাত তুললাম। বললাম, আমি বিনয়ের সঙ্গে এই কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল চার-পাঁচ বছর। সেই অর্থে আমিও তরুন প্রজন্ম। অথচ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ অপরিসীম, এবং অনেক তরুন তরুনীই আমার মতো। আরো বললাম, মুক্তিযুদ্ধ আমার কতোটা অন্তর্গত বিষয় তার প্রমাণ হলো আমার লেখা প্রকাশিত ১৫ টি গ্রন্থের প্রায় অর্ধেকই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। এর মধ্য অপারেশন জ্যাকপট ও মুক্তিযুদ্ধের সেরা লড়াই দুটি প্রমাণ্য গ্রন্থ। (এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় তার জীবনে যে অপরিসীম দুঃখ পেয়েছেন আত্নীয় পরিজন হারিয়ে, তাতে তার অভিমান হলেও দোষ দেয়া যায় না, যে অভিমান আমারও আছে। একদিন হয়তো সেই অভিমানের আগুন বুকে নিয়ে এই নতুন প্রজন্মই বাংলাদেশের নেতৃত্বের হাল ধরবে, আজকে জয়ের সেই অগ্নিময় প্রস্তুতি আমরা দেখতে পাই)।
ডক্টর রেহমান সোবহান সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সমর্থন জানিয়ে বললেন যে, তিনি অপারেশন জ্যাকপট বইটি সম্পর্কে অবহিত কিন্তু এটা জানতেন না যে লেখক বয়সে এতো তরুন।
হান্না পাপানেক সহাস্যে বললেন, তাহলে আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সিলভার জুবিলি-তে বাংলাদেশের কেকটি কাটার দায়িত্ব তোমার এবং তুমিই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইবে। সকলেই উঠে দাঁড়ালেন। আমি কেক কাটলাম যাতে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা। প্রাণ খুলে গাইলাম, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। অবাক ব্যাপার হল এখানে উপস্থিত অনেক আমেরিকানই গলা মেলালেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে। আবেগে, আনন্দে আমার দুচোখ বেয়ে নেমে এলো খুশীর অশ্রুধারা!

ষাটের দশকে ঢাকায় SEATO কলেরা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল যার বর্তমান নাম আই সি ডি ডি আর, বি। এখানে একদল চিকিৎসক গবেষেক ছিলেন যাদের মধ্য অন্যতম জিম টেলর, তাঁর স্ত্রী অ্যানা টেলর, লিংকন চেন, মার্টি চেন, রিচার্ড ক্যাশ, জন রড, কর্নেলিয়া রড, হেনরি মোসলে, ডেভিড নালিন, উইলিয়াম গৃনাফ এবং রবার্ট হির্শনে। ঢাকায় ২৫ মার্চের পাকিস্তানি আক্রমণের পর এরা সবাই বাংলাদেশ ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে আসেন এবং হার্ভার্ড, জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। এখান থেকেই নানান ফোরামে, নানানভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানাতে থাকেন। এঁদের মধ্য লিংকন চেন এবং রিচার্ড ক্যাশ পরবর্তীতে আমার সরাসরি শিক্ষক হয়েছিলেন। তাঁদের কথায় আসার আগে টেলর দম্পতির কথা বলে নিই। জিম এবং অ্যানা টেলর দুজনেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্নক সমর্থন দিয়েছিলেন, প্রতিবাদের প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়েছিলেন আমেরিকার বুকে। বিশেষ করে অ্যানা টেলর মার্চের কালো রাতের ভয়াবহতা জানার পর পর মে মাসেই দুবার প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছিলেন ওয়াসিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসের সামনে এবং পাকিস্তান অ্যাম্বাসির সামনে। শুধু তাই নয়, এই চিকিৎসক দম্পতি হোয়াইট হাউসের সামনে ম্যানহোলের ভেতরে রাত কাটিয়েছিলেন সারা পৃথিবীর মানুষকে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশা বোঝানোর জন্য যে এভাবে ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে পাইপের ভেতরে জীবন যাপন করছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা!

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যতগুলো রিপোর্ট বা পজিশন পেপার জমা দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী লেখাটি লিখেছিলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির তিনজন শিক্ষক; এডওয়ার্ড মেসন, রবার্ট ডর্ফম্যান এবং স্টিফেন মার্গলিন। ২৫ মার্চের কালো রাতে যখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর চলছে নির্মম ব্রাশফায়ার, বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে আমেরিকান সরকার সরাসরি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের বর্বর শাসকগোষ্ঠীকে, তখন এপ্রিল মাসে তাঁদের এই লেখাটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তারলাভ করতে সমর্থ হয়েছিল আমেরিকার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবি মহলে।
লেখাটির শুরুই হয়েছিল এভাবেঃ "The Indepence of East Pakistan is Inevitable" শুধু তাই নয়, এ লেখাতেই প্রথম Bangladesh কে একটি আলাদা শব্দ হিসাবে ব্যবহার করা হয়; Indipendence of East Pakistan-Bangladesh is a matter of time.

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এটি একটি অসামান্য অবদান। এই লেখা আমেরিকার সিনেটের সাবকমিটিতে পাঠানো হয়। ডক্টর মেসন স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন। তাঁর নামে প্রবর্তিত মেসন প্রোগ্রামে বাংলাদেশের অনেক সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তা বিশেষ ট্রেনিং নিতে আমেরিকায় এসেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে।
চাইনিজ বংশোদ্ভূত চিকিৎসক এবং পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ লিংকন চেন এবং তাঁর স্ত্রী মার্টি চেন, একই পেশার জন রড ও তাঁর স্ত্রী কর্নেলিয়া রড ছিলেন বাংলাদেশের একনিষ্ঠ সমর্থক। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় লিংকন চেন ও জন রড পৃথিবীর অন্যতম খ্যাতনামা জার্নাল ল্যানসেট-এ বাংলাদেশের ওপরে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এটি আমেরিকার অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নজরে আসে। অক্টোবর মাসে সিনেটের কেনেডি এই রিপোর্ট প্রবন্ধের ওপরে একটি শুনানীর আয়োজন করেন। সেখানে এই প্রবন্ধের আরো বিস্তারিত বর্ণনা এবং ব্যাখ্যা দেন ডক্টর রিচার্ড ক্যাশ। মার্টিন চেন ও জন রড স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের এন জি ও সেক্টরে সক্রিয় অবদান রেখেছেন।

চিরকুমার রিচার্ড ক্যাশ একজন মানব দরদি চিকিৎসাবিদ ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ। আমরা ছাত্রেরা তাঁকে নাম দিয়েছিলাম ক্যাশলাদেশ। অর্থাৎ ক্যাশ + বাংলাদেশ = ক্যাশলাদেশ। এর যথার্থ কারণও ছিল। তাঁর প্রতিটি ক্লাসে, উদাহরণে বাংলাদেশের ঘটনা, কখনো দুই একটা বাংলা শব্দ বা বাক্যও চলে আসতো তাঁর মুখে। কেমব্রীজ শহরে তার বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম কয়েকবার। ঘরের সাজানো প্রতিটি জিনিশ বাংলাদেশের বা আফ্রিকার কোন দেশের। এমন কি তার প্রতিদিনের শয্যার ওপরে আমেরিকান কমফোর্টার এর বদলে শোভা পায় বাংলাদেশের আড়ং এর তৈরি নকশীকাঁথা। বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থন শুধু মুক্তিযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, তার জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্যে, জীবন দর্শনের মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠান শেষে সবার সঙ্গে আলাদা আলাপকালে কথা হলো। অমর্ত্য সেন স্নেহের ভঙ্গিতে পড়ালেখার খোঁজ-খবর নিলেন। বললেন, আমার সেক্রেটারিকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিও (যা আর কখনও করা হয় নি), আর আমি কেমব্রীজ এর খোলা চত্বরে বেড়িয়ে আমার বুকের উথাল-পাথাল ঝড় কে অনুভব করি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলাদেশের জন্মবার্ষিকী পালন করছি বিশ্বময় খ্যাতিমান এই মানুষগুলোর সঙ্গে। এই আনন্দের মর্মাথ আরও গভীর হলো, খোলাসা হলো আমার কাছে যখন একই বছরের অক্টোবরে ঘটে-যাওয়া আরেকটি ঘটনা মনে পড়লো। সে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা!

১৯৯৬ সালে ঠিক এই সময়ে জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিতে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পর পরই হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখে তিনি কেমব্রীজ ক্যাম্পাসে বক্তব্য রাখেন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক, সময়পোযোগী বক্তৃতা। বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের পরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করার জন্য। এখানে তিনি প্রচন্ড আবেগময়, আবার রাজনৈতিকভাবে তেজি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডির সেই বিখ্যাত উক্তিঃ
‘Let every nations know ...whether it wishes us well or ill..
that we shall pay any price, bear any burden, meet any hardship, support any friend, oppose any foe,to assure the survival and success of liberty..."

আর এই বক্তৃতা তিনি শেষ করেছিলেন আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট এর সেই বিখ্যাত লাইন দিয়েঃ
"I have promises to keep and miles to go before sleep"

এই আবেগঘন এবং প্রাণস্পর্শী বক্তব্যের পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে আমি প্রথম প্রশ্নটি করেছিলাম। আমার প্রশ্নটি ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় অনেক, কিন্তু তা রাখা হয় না। আপনার সরকার বাংলাদেশে একটি উপযুক্ত স্বাস্থ্যনীতির কথা বলে আসছে বহুদিন থেকে। কবে আমরা একটি আধুনিক, এবং সময়োপযোগী স্বাস্থ্যনীতি পবো? তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা বলেছিলেন। এখন, এতো বছর পরও আমরা তাঁর উদ্দেশ্য সেই একই প্রশ্ন ও দাবি রাখতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তৃতা ছাড়াও আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্ব ঘটনা ঘটে একই সময়ে, যার সঙ্গে আমার প্রথমে বর্ণিত ঘটনার একটা গভীর যোগসূত্র আছে। প্রধানমন্ত্রীর আগমন কে কেন্দ্র করে বস্টনে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্য থেকে একটি উদ্যোগ নেয়ে হয় যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে সব হূদয়বান আমেরিকান নাগরিক সরাসরি সাহায্য করেছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাঁদেরকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ সম্মাননা দেয়া হবে। বস্টনের টাফট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সে রকম সতেরজন আমেরিকানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হার্ভার্ডের বাংলাদেশের জন্মদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই ছাড়াও, আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন প্রফেসর রবার্ট রাইন। যিনি ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকান আইনকে ফাঁকি দিয়ে ৯৬ হাজার ডলারের যন্ত্র-সরঞ্জাম মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় আওয়ামীলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এই মহতি উদ্যোগের পেছনে যে মানুষটি মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন তৎকালীন বোস্টন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, বর্তমানে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ডক্টর আবদুল মোমেন। তাঁর যোগাযোগ ও পরিকল্পণার মধ্য দিয়ে সব কিছু আগালেও শেষ পর্যন্ত স্থানীয় রাজনীতির কারণে তাঁকে এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল, যা আমার মনে এখনও পীড়া দেয় এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগের জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আমি মানপত্র টি লিখেছিলাম এবং তা পাঠ করেছিলাম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছিলেন মঞ্জু বিশ্বাস ও ইকবাল হোসেন। এখানে এই অনুষ্ঠানে সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকজন অসামান্য আমেরিকানদের হাতে বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতার নিদর্শন সরূপ ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখকরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে যখন স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয় এবং তা জাতিসংঘে পাঠানো হয়, সেই অনুষ্ঠানের জন্য আমি ’কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি লিখি এবং সেই গানের কপিও তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেই নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পর যে কয়েকটি দেশ সফর করেছিলেন বাংলাদেশ ছিল তার মধ্য একটি। এভাবে একটি জাতি তা যত ছোট হোক বা বড় হোক তার কর্মের মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি দিয়ে পারে। বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার মাটিতে সেই মহান কাজ টি সম্পন্ন করেছিলেন, এজন্য তিনি চিরকাল জাতির বিবেকের ভূমিকা নেয়ার জন্য প্রসংশিত হবেন, স্মরণীয় থাকবেন। সেইদিনের সেই অনুষ্ঠান শেষে তাই মুক্ত বাতাসে গলা ছেড়ে বলে উঠতে পেরেছিলাম,
’আমি এখন মঙ্গলগ্রহের গোলাপি আকাশকে ছুয়ে নিই তৃপ্তির শ্বাস
আমার পায়ের নিচের সোদা মাটি, মুক্ত আকাশ আমাকে পৌছে দেয় বিশ্বময়;
কারণ আমি পেয়েছি আজ স্বাধীন বাংলাদেশ।’
এই স্বাধীনতা, এই মুক্তির অহংকারকে চিরজীবী রাখতে হবে আমাদেরই।

[পুনশ্চঃ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এখন শুধু আমেরকানদেরই নয়, সারা পৃথিবী থেকে এরকম ১০০ জন কে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা আশা করি তা যেন বাস্তবায়িত হয়]
লেখা পূর্ব-প্রকাশিত, যায় যায় দিন, খবর ডট কম)

Saturday, October 22, 2011

সোমালিয়ার যখন হাজার হাজার মুসলমান মরে তখন মুসলমানেরা কী (কি) করেন???!!!


[প্রথমেই জানিয়ে রাখছি সোমালিয়ার স্মরণকালের ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের দিকে সবার নজর দিতে এই লেখা আমি একজন মুসলমান হিসাবে লিখছি না; লিখছি মানবতার অনুসারী হিসাবে, জনস্বাস্থ্য ও বিশ্বসাস্থ্যের একজন চিকিৎসক এবং কর্মী হিসাবে। তবে ইসলাম বা মুসলমানদের নিয়ে কিছু বললেই যে লোকগুলো (বিশেষ করে বাংলাদেশের) তালকানা ষাঁড়ের মতো শিং উঁচিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসেন তাদের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে এই লেখা]



সোমালিয়া, আফ্রিকার শিং হিসাবে খ্যাত এই দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় চারগুণ বড় হলেও লোক সংখ্যা মাত্র এক কোটির একটু ওপরে। এই লোক সংখ্যার ৯৯% মুসলমান। দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে আছে। গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খারায় আফ্রিকার শিং নামে খ্যাত দেশগুলো যেমন কেনিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এই খরায় একেবারে পর্যুদস্ত। কিন্তু সোমালিয়ায় যুদ্ধ আর খরার যৌথ-প্রভাবে দেশটির সবচেয়ে করুণ দশা-এখন জাতি সঙ্ঘের ঘোষিত দূর্ভিক্ষ পীড়িত এই দেশ। এখানে গত তিন মাসে শুধু শিশু মারা গেছে প্রায় ৩০ হাজার, ২০ লক্ষ শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চূড়ান্ত পুষ্টিহীনতায় ভূগছে। জনসংখ্যার সবচেয়ে ভালনারেবল অংশ নারী আর শিশু। অধিকাংশ নারীই সন্তানধারণের বয়সী এবং অর্ধেকই অন্তঃসত্ত্বা। এইভাবে, এই অবস্থায় এখন পর্যন্ত ১৫ লক্ষ সোমালী আশ্রয় নিয়েছে আসেপাশের দেশগুলোতে যা অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। হাজার হাজার নারী আর শিশু মরছে প্রতিদিন। যারা এই ঘটনার আবার সূত্র জানতে চাইবেন (সেইসব স্ক্যাপ্টিক ষাঁড়েরা) তাদের জন্য একটা এলবাম করেছি। এখানে লিঙ্ক দিলাম দেখে নেয়ার জন্যঃ

https://www.facebook.com/media/set/?set=a.10150434065461515.415423.701606514&type=3


এবার দেখি মুসলিম বিশ্ব কী করছে এই দুঃসময়ে! হালাল-হারাম নিয়ে তর্ক, কেউ তাদের গলতি ধরিয়ে দিলে তার দিকে গ্লাভস খুলে আক্রমণ, গালিগালাজ? না, না , তারা এতো খারাপ না! পৃথিবীর ৫৭ টি মুসলিম দেশ একসঙ্গে হয়ে তুরস্কে মিলিত হয়েছে (সূত্রঃ http://pakobserver.net/detailnews.asp?id=109441)

কতলক্ষ টাকা খরছ করেছে সেই একসঙ্গে হওয়ার জন্য জানি না। কিন্তু তুলেছে মাত্র তুরস্কের টাকায় ২০০ মিলিয়ন, মাত্র ১০ টন ঔষধ, আর কি? তবে এটা পাকিস্তানের পত্রিকা এদের বিশ্বাস করা যায় না তাই আরো একটু অনুসন্ধান করে জানা গেল না, একটু বেশি টাকা ঊঠেছে, ও আই সি (OIC) বলেছে তারা ২৩০ মিলিয়ন ডলার দেবে। অথচ জাতিসঙ্ঘের মতে নূন্যতম পক্ষে দুই দশমিক চার বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কী আর করা, দেখি বাংলাদেশ না হয় গরীব দেশ, আমাদের দাসত্বের (মানসিক) মালিকেরা কে কী করছেনঃ



পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ও বিলাসবহুল ইয়ট (জাহাজ আর কি!) কাদের দখলে আর এই জাহাজে কী ঘটে?



১। আল সাঈদ, সৌদী সুলতান কাবুস ওসমান পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল ইয়টের মালিক যার দাম প্রায় ৩০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার (ছবিটি আমার আগের এলবামে দেয়া আছে)।


২। আল সালামাস, প্রিন্স সুলতান বিন আব্দুল আজিজ, সৌদি আরব, দাম ২০০ মিলিয়ন ডলার।



৩। লেডি মুরা, নাসের আল রশিদ, ব্যবসায়ী, সৌদী রয়েল পরিবারের উপদেষ্টা, দাম ২১০ মিলিয়ন ডলার



৪। আল মিরকাব, শেখ হামাদ বিন জসিম আল থানি, কাতারের প্রধান মন্ত্রী, দাম ২৫০ মিলিয়ন ডলার



৫। দুবাই, শেখ মোঃ বিন রাশিদ আল মাখতুম, দুবাই এর প্রধান, দাম ৩৫০ মিলিয়ন ডলার।



৬। সবচেয়ে মজার টি হলো ১০০,০০০ কেজি সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতুতে গড়া প্রায় ৫ বিলিয়ন ( ১০০০ মিলিয়ন এ এক বিলিয়ন, আপনারা গুণে দেখুন কতো) এর মালিক মালয়েশিয়ার একজন অজানা ব্যাবসায়ী।



মধ্যপ্রাচ্যের শেখ-সুলতানেরা প্রতি বছর শুধু বিশ্বের বিলাসবহুল বিপনী বিতানে ব্যয় করেন মিলিয়নস অব ডলারস, নানান দেশে তাদের নিজস্ব হেরেমখানা আছে যেখানে পৃথিবীর নামী দামী তারকা থেকে শুরু করে স্পেশাল নারীদের হাজার হাজার ডলারে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়।



আমাকে আর ফিরিস্তি দেয়ার দরকার আছে? পৃথিবীর যে কোন বিলাসবহুল ব্যায়ের জিনিস খুজে দেখুন কারা এগুলোর মালিক। কিন্তু বিজ্ঞান, জ্ঞান, মানবিকতায় এঁদের নিচের ১০০ জনের মধ্যেও পাবেন না।



আমার দিকে যারা এক্ষুনিই অঙ্গুলি নির্দেশের জন্য মুখিয়ে আছেন (আপনি কি করছেন? বলার জন্য) তাদের উদ্দেশ্যে আগেই বলিঃ আমি মুসলমান হিসাবে বেহেস্ত পাওয়ার জন্য কিছুই করি না। আমি যা করি তা মানুষ হিসাবে করি। আমার সাধ্য মতো আমার জ্ঞান দিয়ে, শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে, অর্থ দিয়ে যতটুকু পারা যায় করি। তার জন্য আমাকে বেহেস্তে যাওয়ার লোভ দেখানোর প্রয়োজন নেই। সুতরাং যারা মুসলমান, ইসলাম ধর্মের রক্ষাকর্তার দায়িত্ব নিতে চান, আপনারাই বলুন আপনাদের এখন কি করনীয় (অন্তত বেহেস্তের জন্য হলেও)। সকলের মংগল হোক।





Friday, September 25, 2009

একজন হুমায়ূন আহমেদ এবং হায়রে বাংলাদেশ!

হুমায়ূন আহমেদ কে নিয়ে কথা বলতে গেলে বা লিখতে গেলে আমি এক ধরনের আবিস্কারের আনন্দ অনুভব করি। আজকে তাঁর প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা বা খ্যাতির বাইরে এক অন্য ধরনের আবিস্কারের আনন্দ, একজন মানুষকে আবিস্কারের আনন্দ। তাঁর লেখা নিয়ে হয়তো বা সবসময় একরকম মন্তব্য করবো না, কিন্তু আবিস্কারের সুখটুকু চিরকাল তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবো। কেন করি সেকথা শুনে আমাকে কেউ নার্সিসিস্ট বা আত্নপ্রেমিক বললেও কোন আপত্তি নেই। তবে এই স্বল্প পরিসরের লেখায় হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ কেন? তার কারণ সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত এবং যায়যায়দিনে পুনঃপ্রকাশিত তাঁর খুব ছোট্ট একটি লেখা হায়রে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে কিছু বলার আগে আমার আবিস্কারের গল্পটি বলে নিই।
ক্লাস এইটে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য স্কুল থেকে একগুচ্ছ বই পুরস্কার দেয়া হলো আমাকে। তার মধ্য অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য বই যা আমার জীবনকে পালটে দিতে সাহায্য করেছিল। জামতৈল নামের এক সাধারণ গ্রামের স্কুলে ছিলেন কয়েকজন অসাধারণ শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে মুজিবর রহমান বিশ্বাস ছিলেন লেখক-প্রাবন্ধিক। প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ স্কুলের শিক্ষক হয়েও সেই গ্রামে বসে ’উপনিষদের দার্শনিক মর্ম ও অন্যান্য আলোচনা’র মতো প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর বই সিলেকশন যে অন্যরকম হবে তা বলাই বাহুল্য। একসঙ্গে পাওয়া বিশ বাইশ টা বই আমি গোগ্রাসে গিলছি। সেখানে জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, চেঙ্গিস আইসমভের গল্প সংকলন। সেই সঙ্গে একজন নতুন লেখকের আনকোরা নতুন বই নন্দিত নরকে। তখন হুমায়ূন আহমেদের নামও শুনিনি। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে হু হু করে কাঁদছি। এক অবর্ণনীয় আনন্দের কান্না, কিশোর বয়েসের যুক্তিহীন আবেগের কান্না নয়, বরং এক পরিনত জীবনবোধের, জীবনকে স্পর্শসুখের আনন্দে কান্না। গ্রামের টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দে ঢেকে যাচ্ছিলো সেই কান্নার শব্দ, আর আমি বার বার বলছিলাম, এই লেখককে খুঁজে বের করতেই হবে।
ঢাকায় এলাম ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য। অনেকটা জীবিকার জন্যই গান লিখি, বেনামে পত্রিকায় ফিচার আর জিঙ্গল লিখি। জিঙ্গল হলো বিঙ্গাপনের গান। নগদ টাকা, তাছাড়া পরিশ্রমও কম। পাশাপাশি উন্মাদ পত্রিকায় মাঝে মাঝে খবর থেকে ছড়া লিখি। এই বিভাগে প্রকাশিত খবর নিয়ে আমার ব্যঙ্গাত্নক ছড়ার সঙ্গে কার্টুন আঁকেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। আহসান হাবীব বন্ধুত্ব্বের সূত্র ধরে একদিন বললেন যে প্রকাশনী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে চান তিনি। আমাকে পান্ডুলিপি দিতে বললেন। তারপর নিজেই তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় বললেন,’আপনার বই ছাপলে তো দেউলিয়া হতে হবে, তার চেয়ে এক কাজ করুন কয়েকজন বিখ্যাত লোকের গল্প নিয়ে একটা সংকলন বের করুন। সেটা দিয়ে ব্যবসা হবে। সেই সঙ্গে আপনার একটা মৌলিক বইও ছাপবো। এই বইয়ের লোকসান পুষিয়ে নেয়া যাবে অন্য বইটি দিয়ে।’
ঠাট্টা করে বললেও কথাটা তো তখন সত্যি ছিল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম কিশোর রহস্য গল্প সংকলনের কাজে। আমার উৎসাহ আরো বেশী, কারণ আমার মৌলিক ছড়াগ্রন্থ হাবিজাবি বের হবে একই সঙ্গে। তাছাড়া সেই প্রথম জানলাম লেখক হুমায়ুন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার সহোদর। যাকে সেই ছোটবেলায় খুঁজে বের করার পণ করেছিলাম তিনি হাতের নাগালে, এতো সহজে। আহসান হাবীব সাবধান করে দিয়ে বললেন,’আপনি সম্পাদক, আপনার দায়িত্ব আমার ভাইয়ের কাছে থেকে গল্প আদায় করা। এই কাজে সফল হওয়া অনেকটা পুলসেরাত পার হওয়ার সমান।’ পুলসেরাত পার হলাম। উননব্বই এর বইমেলায় শওকত ওসমান, শওকত আলী, রাহাত খান, হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন সহ দশজন গল্পকারের দশটি আনকোরা গল্প নিয়ে বের হলো কিশোর রহস্য গল্প। সেই সঙ্গে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আমার ছড়াগ্রন্থ হাবিজাবি।

রহস্য গল্প সংকলনটি একেবারে ব্যবসা-সফল প্রকাশনা হিসেবে বাজারে স্থান করে নিলো। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে বই পড়া যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো সেখানেও নির্বাচিত হলো বইটি। সেই সঙ্গে আমার প্রথম বই হাবিজাবি পেলো শিশু একাডেমী থেকে পুরস্কার। জন্ম হলো আজকের একটি সফল প্রকাশনী সংস্থা দিনরাত্রি প্রকাশনী। কিন্তু আমার কাছে এগুলোর চেয়েও বড় পুরস্কার কিশোর বয়েসের আবিস্কার করা সেই প্রিয় লেখকের পারিবারিক বন্ধুত্ব।
হুমায়ুন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন আমেরিকায় তখন প্রায়ই আহসান হাবীবের সঙ্গে তার কল্যানপুরের বাসায় যেতাম। সেখানে তার সঙ্গে থাকতেন এই ত্রিরত্নের মা। নিজের ছেলের মতো খাবারের পাতে কই মাছ তুলে দিতে দিতে আক্ষেপ করতেন, তাঁর বড় শখ ছিলো একটি ছেলে ডাক্তার হোক। আমি বলতাম খালাম্মা, ’আমরা চাই আর না চাই দেশে প্রতি বছর অন্তত বারশো ডাক্তার তৈরি হবে। সেটারও দরকার আছে, কিন্তু প্রতি বছর দেশ তো বারজন লেখকের জন্মও দিতে পারে না। ভালো লেখক জন্মায় যুগে যুগে।’ তিনি স্নেহ-মাখা শাসনের সুরে বলতেন এইজন্য লেখক হওয়ার আশায় মেডিক্যালের পরীক্ষা বাদ দিয়া বইমেলার কাজ করো, না?গল্প করতে করতে কখনও তিনি ’শাহীনের বাবার’ কথা বলতেন। শাহীন আহসান হাবীবের ডাক নাম। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক পিতার কথা বলতেন। একজন মুক্তিযুদ্ধের শহীদের কথা বলতেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বুকে গভীর, বিশাল এক ক্ষত আছে। কোন নিকটজন হারাবার বেদনার চেয়েও গভীর। নিকটজন হারানো এক ধরনের কষ্ট। তাতে কষ্টের নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এই কষ্টও বিশাল। কিন্তু কিছু কষ্ট, কিছু ক্ষত নিষ্পত্তিহীন। কী এমন কষ্ট যা নিকটজন হারানোর বেদনার চেয়েও গভীর, বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করে মনে? তার উত্তর আজ দিতে পারবো না। কেউ জিগ্যেস করলেও বলতে পারবো না। বলবো কোন একদিন সময় হলে। অন্যদিকে আজকাল এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানান রকমের ব্যবসা; মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ভন্ডামি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের পন্যের পসরা, মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে তুলে ফেলা হয় মুৎসুদ্দি মুদির দোকানদারি আর দালালদের ঝোলাতে। এই ক্ষত নিয়ে তাই যখনই কোন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত বা শহীদ পরিবারের সামনে দাঁড়িয়েছি তখনই অপরিসীম বেদনায় ছেয়ে গেছে মন। এজন্য বোধকরি কিশোর বয়েসে আবিস্কার করা লেখক লেখকের অধিক হয়ে ধরা দিতেন আমার মনে।
কাউকে ভালোবাসলেই একধরনের অধিকারবোধের জন্ম হয়। এই অধিকারবোধের কারণেই মনে হয় বার বার ছুটে গেছি হুমায়ুন আহমেদের কাছে। প্রশয়ও পেয়েছি তার কাছে। সেই শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের এ্যাপার্টমেন্ট, হাতির পুল বাজারের অপেক্ষাকৃত বড় এ্যাপার্টমেন্ট থেকে আজকের ধানমন্ডির প্রাসাদোপম বাড়ি, সবর্ত্রই অবাধ প্রবেশাধিকারের প্রিভিলেজ পেয়েছিলাম। প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষ বলেই তার কাছে থেকে আশা করতাম আরও বেশী। কিন্তু কখনও তাবেদার স্তুতিকারকে পরিনত হইনি। বরং প্রয়োজনে অন্য সবার চেয়ে সমালোচনায় উচ্চকিত হতাম তার সামনেই। অন্য সবার কাছে থেকে শুনতাম তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তিনি অহংকারী ইত্যাদি। আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করিঃ

তার মেফ্লাওয়ার সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। একদিন তার বাসায় গিয়েছি, ঠিক তখনই প্রকাশক লেখক কপি পৌছে দিলেন বাসায়। সেখান থেকে একটি কপি দিলেন তিনি । তখন হস্টেলে থাকি। বইটি পড়েই পেলাম একটি বড় তথ্যগত ভুল। লেখা আছে আমেরিকায় ডঃ ক্লার্কের বাসায় অনেক দূর্লভ জিনিসের মধ্যে দু’হাজার বছরের পুরনো কোরান শরিফের পাতা। হস্টেলের কয়েন বক্স থেকেই সাথে সাথে ফোন করলাম। কোরান শরিফের বয়সই তখন দুহাজার বছর হয়নি। তিনি বললেন ভালো বলেছো, এক্ষুনি পাবলিশারকে ফরমাটা নতুন করে ছাপতে বলি। কিম্বা কোথাও কেউ নেই নাটকের রিহার্সেল হচ্ছে বিটিভির একটি কক্ষে। হঠাৎ তুমুল বিতর্ক শুরু হলো। একপক্ষে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরীদি, সূবর্ণা মুস্তাফা অন্যদিকে হুমায়ুন আহমেদ। অভিনেতাদের বক্তব্য হলো টিভির বাংলা নাটকের একটি স্ট্যান্ডার্ড, শুদ্ধ ভাষা থাকা উচিত। হুমায়ুন আহমেদের বক্তব্য না, নাটকের ভাষা হবে আমাদের মুখের ভাষা। কথ্য ভাষা। দু’পক্ষেরই অকাট্য যুক্তি। কিন্তু কেউ মনে হচ্ছিল আসল কথাটা বলে নাট্যকারকে চটাতে চাচ্ছিলেন না। আমি সেখানে দর্শকমাত্র। আমার স্ত্রী, তৃষ্ণা মাহমুদ একজন অভিনয় শিল্পী ঐ নাটকে। আমি তার ড্রাইভার বলা যায়। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিতর্কে। হুমায়ুন আহমেদকে উদ্দেশ করে বললাম, ’নাটকে কথ্য ভাষা থাকবে ভালো, কিন্তু একেকজন একেকরকম কথ্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকলে একসময় ভাষাটাই একটা জগাখিচুরিতে পরিনত হয়। সাহিত্যের একটি বড় দায়িত্ব ভাষাকে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে দেয়া। তাছাড়া লোকভাষারও শুদ্ধ রূপ আছে। অথচ আমরা লোকভাষার নামে আঞ্চলিকতাদুষ্ট ভাষা ব্যবহার করছি। যেমন আপনার লেখায় শুনা, উঠা, পুড়ানো ইত্যাদি, সমাপিকা আর অসমাপিকা ক্রিয়ার উলটো ব্যবহার দেখা যায়।’হল ভর্তি লোক স্তম্ভিত আমার স্পর্ধা দেখে। আমি বুঝতে পারছি না বাসায় যতই হুমায়ুন ভাই বলি না কেন, এতো লোকের সামনে এভাবে বলাটা ঠিক হলো কি না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যা, সেজান ঠিকই বলেছো। আমার লেখার এটা ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার দোষ। সেদিন থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলো।
তার কাছে অন্যায় আবদারও করেছি কখনও। যেমন কোথাও কেউ নেই নাটকে আমার স্ত্রী তৃষ্ণা তিন কন্যার একটি চরিত্র রূপায়ন করছিলেন। একবার পত্রিকায় খবর বের হলো যে এই চরিত্রটি বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেবে। এখবর বের হবার পর হাসপাতালের গাইনী বিভাগের রোগীরা পর্যন্ত বেঁকে বসলো। তৃষ্ণা তখন মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনী বিভাগে ইন্টার্নি করছিল। তাদের সোজা বক্তব্য, ’আপা আপনে যদি মিথ্যা স্বাক্ষী দেন তাহলে আপনার হাতের চিকিৎসা নিবো না’। মহা মুশকিল! সেটা এমন পর্যায়ে গড়ালো যে একদিন তৃষ্ণা এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে আমাকে বললো, তুমি হুমায়ুন ভাইকে বলো যেন আমার চরিত্রটিকে দিয়ে স্বাক্ষ্য না দেয়া হয়। আমি ভীষণ অবাক। কারণ ওর মনের জোর আমি জানি। বাংলাদেশের মতো সামাজিক অবস্থায় টিভি নাটকে একজন কলগার্লের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য যে কি ধরনের অবস্থার সন্মুখিন হতে হয় তাও জানি। এমনকি মেডিকেলে পড়া ক্লাসমেটরা যখন সিটি বাজিয়ে বলতো, রেট কতো? তখনও ওকে বিচলিত হতে দেখিনি। বরং বলতো, ওদের জন্য আমার করুনা হয়। দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত লোকগুলোর যদি এই মেন্টালিটি, তাহলে রিক্সাওয়ালাদের কি দোষ? সেই মানুষ এতোটা ভেঙ্গে পরেছে। বললাম, তুমি তো জানো এটা বলাটা উচিত না। তুমি গ্রুপ থিয়েটার করা মানুষ হয়ে কীভাবে এটা বলতে বলছো? উত্তরে বললো, আমি জানি, আমি অভিনয়ের চেয়ে ডাক্তারি করাই বোধহয় বেশী ভালোবাসি। দুজনে সোজা হুমায়ুন আহমেদের বাসায় হাজির হলাম। সব শুনে তিনি বললেন, তুমি ডাক্তার না হলে হয়তো এটা করতাম না। গরীব দেশ, অশিক্ষার দেশ, এখানে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। তিনি স্ক্রীপ্ট পালটে দিলেন। অন্যায় আবদার করার জন্য যে ভার বুকে চেপে ছিলো মুহূর্তেই তা নামিয়ে দিলেন তিনি।
এভাবেই আবিস্কার আর ভালোবাসার দাবিতে, কখনও একপাক্ষিকভাবেই তার কাছে অধিকার ফলিয়েছি। কখনও লেখা পড়ে আশাহত হলে চিৎকার করে বলেছি ’হেকনিক প্লট’। কিন্তু কখনও বিশ্বাস হারাইনি তার ওপর থেকে। একবার সেরকম হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমার এক ঘনিষ্ঠবন্ধু এসে বললো ’যে হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে বড় বড় কথা বলিস তিনি তো ঢাকা ভার্সিটিতে জামাতের হয়ে ইলেকশন করছেন’। আমি ইউনিভার্সিটির এইসব রাজনীতি বুঝি না। তাই কথাটাকে তাৎক্ষিনিকভাবে বিচার করতে পারছিলাম না। সে বছরই বইমেলায় প্রকাশিত আমার কিশোর উপন্যাস তুষার মানব উৎসর্গ করেছি হুমায়ূন আহমেদকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম ’ কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ, যাঁর নিঃশঙ্ক হাত ধরে পৌছে যাই আমাদের নন্দিত নরকে’। একজন লেখক জানেন একজন লেখকের উৎসর্গ কতখানি গভীর অনুভব থেকে উৎসৃত। এই বইয়ের একটা কপি নিয়ে সোজা তার বাসায় হাজির হলাম। তাকে দিলাম বইটি। নেড়ে চেড়ে দেখে বললেন,

-থ্যাঙ্ক ইউ। খুব ভালো প্রোডাকশন। বিক্রী-টিক্রী হয়?
বললাম,

-বেশ হয়। কিন্তু আমি শুধু এ বইটি দিতে আসিনি। আজকে আমার একটা প্রশ্ন আছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

-বলো কি প্রশ্ন।

সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-শুনেছি আপনি নাকি ভার্সিটিতে জামায়াতের হয়ে ইলেকশনে দাড়িয়েছেন? কথাটা ঠিক কি না? তাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই বললাম, আমার বইটি উৎসর্গ করেছি আপনাকে। আপনি বড় লেখক। এরকম উৎসর্গপত্র শত শত পেতে পারেন। কিন্তু এটা আমার কাছে অনেক বড়। আপনার উত্তর যদি ’হ্যাঁ’ হয় তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা নতুন ঘটনা ঘটবে। আমি প্রেস ক্লাবে গিয়ে প্রেস কনফারেনস করে আমার উৎসর্গপত্রটি তুলে নেবো। মানুষ জানবে একজন ক্ষুদ্র লেখক তার প্রতিবাদ জানিয়েছে তার উৎসর্গপত্র তুলে নিয়ে।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে সোজা উত্তর দিলেন, বললেন -না।

আমি আবার ভারমুক্ত হলাম। একজন স্পর্শকাতর মানুষের জন্য সবচেয়ে কষ্টের কাজ হলো কাউকে শ্রদ্ধার আসন থেকে টেনে নামানো। আমাকে তা করতে হয়নি। আমাকে হারাতে হয়নি তার প্রতি আমার বিশ্বাস।
সেদিন ভাবী বললেন রাতের খাবার খেয়ে যেতে। খাওয়ার পর সবাই গল্পে মশগুল। খেয়াল করি অনেকক্ষণ তার কোন সাড়া-শব্দ নেই। আমি ড্রয়িং রুমে এসে দেখি কেউ নেই। সেই রুমে কোন ফার্নিচার ছিল না। অনেকগুলো কুশন ছড়ানো, আর নিচু একটা টেবিলে তার লেখার কম্পিউটার। মেঝেতে বসেই লিখতেন তিনি। কাঁচের স্লাইডিং ডোর খুলে দেখি রাতের ব্যস্ত ঢাকা, হাতিরপুল বাজারের শোরগোল, আর এরমধ্যেই অন্ধকার বারান্দার এককোনে হাঁটু ভাজ করে গুটিশুটি মেরে বসে আছেন তিনি, দূরে কোথাও তাকিয়ে। চারপাশের আলোর আভায় পাশে থেকে দেখতে পাই তার চোখ ভেজা। কাঁদছেন হুমায়ুন আহমেদ। আমাকে দেখার আগেই আমি নিঃশব্দে সরে আসি। একজন লেখকের কতরকম যন্ত্রণা থাকে! অসংখ্য মানুষের জীবনের কষ্টকে বুকে ধারণ করে, নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে তুলে আনতে হয় শিল্পের হীরকখন্ড, নিজেকে ভাঙতে হয়, গড়তে হয় কত না অজানা বেদনায়। কারো কি চোখে পরে সেই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ?
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী, যিনি তার গাড়িতে বাংলাদেশের রক্ত খচিত পতাকা উড়িয়ে প্রতাপের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, সেই ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা বীরদর্পে ছাত্র শিবিরের সম্মেলনে বললেন একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোন ভুল করেনি। বিদেশের মাটিতে বসে এই সংবাদ পড়ে রাগে-দুঃখে স্তব্দ হয়ে বসেছিলাম। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো বা ছুটে যেতাম তার কাছে। আপনার মতো শক্তিশালী লেখক, শহীদের সন্তানও কি নিশ্চুপ থাকবে? তাহলে দেশের বিবেকেরা কোথায়? কিছুদিন আগে যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রীদের ওপর নির্বিচারে লাঠি চালিয়ে ছিলো পুলিশবাহিনী, সেদিন সবচাইতে শক্তিশালী লেখাটি লিখেছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আজকে এদের কেউই কি জেগে নেই? এরকম ভাবতে ভাবতে, বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে কিছুই করতে না পারার কষ্টে লেখার জন্য কম্পিউটার টেনে নিয়েছি। ঠিক তখনই চোখে পড়লো প্রথম আলোতে তার লেখা ’হায়রে বাংলাদেশ’। ছোট্ট, ধারালো, তীব্র একটি লেখা। তিনি আবারও বাড়িয়ে দিলেন তার নিঃশঙ্ক হাত, আবারও জাগিয়ে দিলেন জাতির বিবেক। একজন সত্যিকারের লেখক কখনও পারেন না বিবেকের দায়ভাগ এড়াতে। এক হতভাগা দেশ, হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার জন্য আপনার এই বিবেক যেন চিরকাল জাগ্রত থাকে, এ আমার ভালোবাসার দাবী। হুমায়ুন আহমেদ, আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ।

*লেখাটি সাপ্তাহিক যায় যায় দিন এ পূর্ব প্রকাশিত

পুনশ্চঃ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পর অনেক পাঠক ইমেইল করে জানতে চেয়েছিলেন সেদিন হুমায়ূন আহমেদ কে কাঁদতে দেখা মানে কি তিনি আসলে অপরাধবোধ থেকে কেদেছিলেন কি না। আমার উত্তর, না। আমিও তা বলতে চাই নি। আমি শুধু একজন লেখকের কষ্টকে ইঙ্গিত করেছিলাম, সৃষ্টির পেছনের যন্ত্রণাকে নির্দেশ করেছিলাম।
সে. মা.


কোথাও কেউ নেই নাটকের লিংকঃ


Saturday, September 5, 2009

সোয়াইন ফ্লু চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ বাংলাদেশের জন্য কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পদক্ষেপ

[ সেপ্টেম্বর ১, ২০০৯ তারিখে খবর ডট কম-এ সোয়াইন ফ্লু ইনফেকশন নিয়ে উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের কীভাবে চিকিৎসা করা উচিত, বিশেষ করে শিশু বা গর্ভবতী মাদের, তা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। গত সেপ্টেম্বর ২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুই বিশেষজ্ঞ দুই রকমের মতামত দিয়েছেন। একজন বলছেন এক বছরের নিচের শিশুদের এটা চিকিৎসা দেয়া যাবে না, অন্যজন বলছেন যাবে। এই দ্বিমতের মূল কারণ সর্বশেষ নির্দেশনা না জানা। মূলত এই বিতর্ক নিরসনের জন্যেই লেখাটি লিখেছিলাম। এই লেখা পড়ে বাংলাদেশ থেকে অনেক তরুন চিকিৎসক ইমেইল করেছেন, ফেসবুকে অনুরোধ করেছেন যেন ছোট-বড় সবার চিকিৎসার নির্দেশনা নিয়েই যেন একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা লিখি, তাতে অনেকেই উপকৃত হবেন। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ও ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফ, ডি, এ) ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ভিত্তিতে এই লেখা মূলত চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য লিখলাম। তবে সাধারণ পাঠকেরাও উপকৃত হবেন- সেজান মাহমুদ]

বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইচ ওয়ান এন ওয়ান (H1N1) ভাইরাস বা সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের প্রকোপ দেয়া দিয়েছে। বাংলাদেশেও আজ পর্যন্ত ২৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এখানে মনে রাখতে হবে যে এই ২৪৮ জন বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে চিহি¡ত রোগি। এর বাইরেও অনেক রোগী আছেন একথা ধরে নেয়া অসমীচীন নয়। বাংলাদেশের মতো উষ্ণ জলবায়ু, আদ্রতা বা হিমিডিটি এবং ঘনবসতির জন্য এই ভাইরাস ভয়াবহ হতে পারে, বিশেষ করে ’হাই রিস্ক’ বা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে। এই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন, পাঁচ বছরের নিচের শিশু, গর্ভবতী মা, বয়স্ক ব্যক্তি যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি যাদের কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাঁপানী, হূদরোগ, কিডনীর রোগ, এবং এইডস আছে। বিশেষজ্ঞজনেরা এর মধ্যে ভবিষ্যতবাণী দিয়েছেন যে এই ভাইরাস ধীরে ধীরে পৃথিবীর উত্তর বলয়ে ব্যাপক আকারে আক্রমণ করবে। তবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা দেয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এর চিকিৎসা ও প্রতিরোধের প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। সরকার ইতোমধ্যে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন তার অসম্পূর্ণতা না সম্বনয়হীনতা যেন দ্রুত অতিক্রম করা হয় এই আবেদন করবো এবং এখানে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে দ্বিমতগুলো দেখা দিয়েছে তার উত্তর দেবার চেষ্টা করবো। যেহেতু এই ভাইরাস সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো কাশি, হাঁচি বা ভাইরাসে দূষিত বস্তুর সংস্পর্শে বা আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ বা নাকে সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই এর প্রতিরোধের জন্য সাধারণ নিয়মগুলো জনগণের মধ্য ব্যাপকহারে প্রচার করা জরুরি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশি বা হাঁচির সময় নাক ও মুখ ঢেকে রাখা, ঘন ঘন হাত সাবান দিয়ে ধোয়া, বিশেষ করে কাশি বা হাঁচির পর; চোখ, নাক, মুখ হাত দিয়ে না ধরা, অসুস্থ হলে (ফ্লু'র মতো) কমপক্ষে ২৪ ঘন্টা ঘরে থাকা, খুব জরুরী না হলে বাইরে বের না হওয়া, ঘর-বাড়ির সাধারণ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ইত্যাদি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো স্বল্প সুবিধার দেশে শুধু লক্ষণ থেকেই উচ্চ ঝুঁকির রোগীদের চিকিৎসা দেয়া জরুরী। প্রথমে এই শ্রেনীর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের চিকিৎসার নীতি কি হবে?



এক. ট্যামিফ্লু (ওসেলটামিভির) শুধু মাত্র এক বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিশুদের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে এক বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকর নয়। যেহেতু এক বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই সোয়াইন ভাইরাস মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে তাই তাদেরকে নিম্নোক্ত চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে বলে অতি জরুরি অনুমোদন দেয়া হয়েছেঃ

  • তিন মাসের কম বয়সী শিশুদের ১২ মিলি গ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য

  • তিন থেকে পাঁচ মাসের শিশুদের ২০ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য

  • ছয় থেকে এগারো মাসের শিশুদের ২৫ মিলিগ্রাম দিনে দু’বার পাঁচ দিনের জন্য
এখানে মনে রাখতে হবে যে এই শিশুদের চিকিৎসা করতে হবে গভীর পর্যবেক্ষনের সঙ্গে যাতে যে কোন প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে নিচের লক্ষণগুলো দেখলেই জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবেঃ
  • শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস

  • চামড়া নীল হয়ে যাওয়া বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া

  • শিশু যদি যথেষ্ঠ পরিমানে দুধ বা পানীয় পান না করে

  • বার বার বমি করা

  • মাত্রাতিরিক্ত ঘুমানো বা নেতিয়ে পড়া

  • মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে থাকা

  • ফ্লু'র লক্ষণ প্রশমিত হয়ে আবার জোরালো ভাবে জ্বর ও কাশিসহ ফিরে আসা

দুই. আঠারো বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর কমানোর জন্য কোন ভাবেই অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা যাবে না। প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রুফেন দেয়া যেতে পারে।
তিন. গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের অনেক ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে। এ কারণে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা করা জরুরী। যদিও ওসিলটাভির ও জানামিভির এই দুটো ওষুধ গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে কখনও পরীক্ষা করা হয় নি কিন্তু এই দুটো ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তেমন ক্ষতিকারক নয়। এর মধ্যে ট্যামিফ্লু বা ওসিলটাভিরই বেশি নির্ভরযোগ্য।

চার. এইচ আই ভি তে আক্রান্ত রোগীরা অন্য সাধারণ মানুষের মতোই সমান ঝুকিপূর্ণ। কারণ যদিও এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে কিন্তু সিডি৪ নামক প্রতিরোধের নিয়ামকটি সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে তেমন ভূমিকা রাখে না। তাহলে এরা কেন উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ? এর কারণ সোয়াইন ফ্লু থেকে যে অন্য জটিলতাগুলো দেখা দেয় যেমন নিউমোনিয়া, তা ভয়ানক ক্ষতি করতে পারে, এমন কি জীবনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এজন্য এইচ আই ভি আক্রান্তদের এন্টিভাইরাস ঔষধ দেয়া জরুরী, তার চেয়েও জরুরী এদের অন্য সাধারণ চিকিৎসা ঠিক রাখা, যেমন সিডি৪ নম্বর ২০০ এর ওপরে রাখা, নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করানো ও অন্যান্য সহযোগী চিকিৎসা ঠিক রাখা। এক্ষেত্রে ওসিলটাভির ও জানামিভির এই দুটো ঔষুধ ব্যবহার করা যাবে।

পাঁচ. বড়দের ক্ষেত্রে ফ্লু'সহ নিচের লক্ষণগুলো দেখলেই জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবেঃ
  • শ্বাসকষ্ট বা ছোট ছোট শ্বাস প্রশ্বাস

  • বুকে বা পেটে ব্যথা

  • হঠাৎ মাথা ঘুরানো

  • মানসিক বিভ্রান্তি

  • বেশি বেশি বমি হওয়া

  • ফ্লু'র লক্ষণ প্রশমিত হয়ে আবার জোরালো ভাবে জ্বর ও কাশিসহ ফিরে আসা
বড়দের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য ওপাত্ত থেকে নিম্নোক্ত ডোজে চিকিৎসা এমনকি প্রতিষেধমূলক (প্রফাইলেক্সিস) চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। প্রতিষেধমূলক চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে তাদেরকে যারা কোন সোয়াইন ফ্লু আক্রান্ত রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন বা শারীরিকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে প্রথম সংস্পর্শে আসার দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত চিকিৎসা নিম্নোক্ত পরিমানে দিতে হবে। তবে যদি কোন রোগীর রোগের সাতদিন পার হবার পরে সংস্পর্শে আসা-হয় তবে আর প্রতিষেধমূলক (প্রফাইলেক্সিস) চিকিৎসার পয়োজন নেই।


ওষুধের নাম চিকিৎসা
ট্যামিফ্লু বা ওসেলটাভির পরিনত বয়সঃ
৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাপ, দিনে দু’বার পাঁচ দিন

প্রতিষেধমূলক চিকিৎসা
- ৭৫ মিলিগ্রাম ক্যাপ, দিনে একবার
শিশুঃ এক বছরের বেশি
১৫ কেজি বা কম ওজন
চিকিৎসাঃ ৬০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ - ৩০ মিলিগ্রাম দিনে একবার
১৬-২৩ কেজি
চিকিৎসাঃ ৯০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ -৪৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার
২৪-৪০ কেজি
চিকিৎসাঃ ১২০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ -৬০ মিলিগ্রাম দিনে একবার
>৪০ কেজি
চিকিৎসাঃ ১৫০ মিলিগ্রাম প্রতিদিন দিনে দুই ভাগে ভাগ করে
প্রতিষেধমূলক চিকিৎসাঃ - ৭৫ মিলিগ্রাম দিনে একবার
জানামিভির পরিনত বয়স
চিকিৎসাঃ দুইবার ৫-মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে দুবার
প্রতিষেধমূলকঃ -দুইবার ৫মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে
টেনে নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে একবার
শিশু সাত বছর বা বেশি
চিকিৎসাঃ দুইবার ৫-মিলিগ্রাম শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া
(১০মিলি মোট) দিনে দুইবার

প্রতিষধমূলকঃ দ-৫-মিলিগ্রামশ্বাসের সঙ্গে টেনে
নেয়া (১০মিলি মোট) দিনে একবার
চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে সব রোগীর জন্য এই ব্যয়বহুল ওষুধের প্রয়োজন নেই। একজন ডাক্তার রোগীর বয়স, শারীরিক অবস্থা, অন্যান্য রোগের সহাবস্থান, উপসর্গের মাত্রা ইত্যাদি বিবেচনা করে এই চিকিৎসা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেবেন। সোয়াইন ফ্লু চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে একথাও বলা জরুরী যে কোন অবস্থাতেই আতঙ্কিত না হয়ে সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়া খুব গুরুর্ত্বপূর্ণ। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অন্য অনেক যুগের মতো এই সোয়াইন ফ্লু’কেও জয় করা সম্ভব হবে। এই প্রত্রিয়ায় সকলেই সামিল হোন।

সেপ্টেম্বর ০১-০৩

লেখকঃ
সহযোগী অধ্যাপক, জনস্বাস্থ্য
ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথ
ফ্লোরিডা এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটি, ইউ, এস, এ।

অতিরিক্ত তথ্যের জন্য পড়ুনঃ



http://www.fda.gov/downloads/Drugs/DrugSafety/InformationbyDrugClass/UCM153546.pdf










Saturday, August 15, 2009

সেলিম আল দীনঃ কিছু স্মৃতি কিছু প্রশ্ন


গত সোমবার (জানুয়ারি ১৫, ২০০৮) আধুনিক বাংলা নাটকের অন্যতম পুরোধা, বাংলা নাটককে বিশ্বমানে উন্নীত করার অগ্রগণ্য সৈনিক সেলিম আল দীন মৃত্যুর সংগে লড়াই করতে করতে অবশেষে চিরদিনের মতো চলে গেলেন। চলে গেলেন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, ভক্ত, অনুরাগী, প্রিয়জন, সর্বোপরী বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিশালী ধারাকে কিছুকালের জন্যে হলেও কান্ডারীবিহীন করে দিয়ে।


এ্যাংলো-আইরিশ নাট্যকার, লেখক অস্কার ওয়াইলড একবার বলেছিলেন, ’এই পৃথিবী এক নাট্যশালা, কিন্তু এর পাত্রপাত্রি নির্বাচন করা হয়েছে একদম বাজে ভাবে ’। নাটকান্তপ্রাণ সেলিম আল দীন একথা খুব ভালোভাবে জানতেন বলেই বোধহয় কখনও রাজনীতি বা ক্ষমতা নিয়ে কোন ধরনের টানাহেচরাতে যেতেন না। বরং নিভৃতে, নিরালায়ে গবেষক, ধ্যানীর একাগ্রতা নিয়ে কাজ করে গেছেন আপন মনে। আর তারই ফলশ্রুতিতে ’কেরামত মঙ্গল’, ’চাকা’, ’হাত হদাই’, ’যৈবতী কন্যার মন’, ’বনপাংশুল’, ’প্রাচ্য’, ’নিমজ্জন’ বা ’স্বর্ণবোয়াল’ -এর মতো আধুনিক, বিশ্বমানের নাটকের জন্ম।
সেলিম আল দীনের সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় সেই আশির দশকের শেষদিকে তাঁরই এক ছাত্র ’রাজু’র মাধ্যমে। আমরা তখন ’ডকুমেন্টারি ড্রামা’ বা ’কমিউনিটি থিয়েটার’ এর ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য-শিক্ষাকে একেবার সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া যায় কিনা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে চায়ের কাপে ঝড় তুলি। রাজুই একদিন বললো, ’আমি সেলিম স্যারের কাছে তোমাদের গল্প করেছি, তিনি জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটির বাসায় নেমন্তন্ন করেছেন।’ তখন তৃষ্ণা আর আমি নিমগ্ন প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনিতেই পুরনো ঢাকার মেডিক্যাল কলেজের গন্ডি পার হয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। সেদিন জাহাঙ্গীর নগরে সেলিম ভাইয়ের বাসায় সারাদিন কাটিয়েছিলাম। প্রথম পরিচয়ে মানুষ যে এতোটা কাছে টেনে নিয়ে পারেন আমার ধারণা ছিলো না। গল্প, নাটক নিয়ে আলোচনা চললো; তখন আমিও টগবগে তাজা তরুন, তড়িৎ গতিতে কথায় চলে আসে ইস্কিলাস, মলিয়ের, কাম্যু, আরও কত কি! খুব গর্বের সংগেই বলি, সেলিম ভাই ভীষণ পছন্দ করেছিলেন সেই একদিনেই। নিজের হাতে নিজের রোপা গাছ থেকে পেয়ারা এনে খাওয়ালেন। সেলিম ভাই এবং ভাবীর গাছ লাগানোর শখ ছিল খুব।তারপর থেকে শুধু যোগাযোগ একটা সম্পর্কে দাড়িয়ে গিয়েছিল খুব কম সময়েই। তাঁর সংগে সম্পর্কের একটি ঘটনা না বললেই নয়, তার কারণ এটি আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় ঘটনার একটি। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেলিম ভাইয়ের ধারাবাহিক নাটক হচ্ছে, ’ছায়াশিকারী’। তৃষ্ণা তাতে একটি চরিত্রে অভিনয় করছে। নাটকের রিহার্সেল হবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি রুমে। ফোনে কথা বলার সময় সেলিম ভাই বললেন তুমিও চলে আসবে রিহার্সেলে। আমি বললাম, আমি কেন? আমি হয়তো তৃষ্ণাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো। সেলিম ভাই বললেন, না, তুমি থাকবে এই রিহার্সেলে, তোমার কাজ হবে ক্যারেক্টারগুলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যাখ্যা করে দেয়া। এ আবার কেমন কথা? কোন নাট্যকার কি এটা করেন? এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন সেই সময়ের সব প্রতিশ্রুতিশীল, এখনকার স্বনামখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, শহীদুজ্জামান সেলিম, আফসানা মিমি, নাদের চৌধুরীসহ আরও অনেকে। নাটকের কোন চরিত্র কেমন হবে না হবে এগুলো নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আমি বললাম, ‘এই নাটকটিকে গুন্টার গ্রাসের টিনড্রামের সংগে তুলনা করলে কেমন হয়? সেখানে যেমন প্রধান চরিত্রটি প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ঘোষণা করে সে আর বড় হবে না, অর্থাৎ প্রতিবন্ধী থেকে যাবে, এখানেও নাটকের প্রত্যেকটা চরিত্র কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী, একধরনের সীমাবদ্ধতায় বন্দী, এটাও একধরনের প্রতিবাদ। তারপর যার যার অবস্থান থেকে চরিত্রায়ন করা যায়।’সেলিম ভাই আমার মনতব্য ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। বলেছিলেন তুমি ঠিক আমার মনের কথাটি ধরে ফেলেছো। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। এই নাটকে একটি চরিত্র ছিল অন্ধ একজন শিল্পীর। সেলিম ভাই বললেন, এই চরিত্রে সেজান অভিনয় করো। আমি জানি যারা এটা শুনেছিলেন ঐ সময়ে তারা নিশ্চয়ই অবাক ও ঈর্ষান্নিত হয়েছিলেন। আমি নিজেও জানি না তিনি কেন এটা বলেছিলেন, এবং এটা যে কথার কথা ছিল না তাও প্রমানিত যখন তিনি রিহার্সেলের পরেও কয়েকবার বলেছিলেন তার মধ্য দিয়ে। আমি বলেছিলাম, ’সেলিম ভাই, আমি পর্দার আড়ালে থাকার মানুষ। তাছাড়া আমি নাটকে আভিনয় করলে আমি একবারেই শেষ, আর না করলে আমি সারা জীবন বলতে পারবো বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার আমাকে তাঁর নাটকে আভিনয় করতে বলেছিলেন। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’ সেই চরিত্রটি পরে খ্যাতিমান অভিনেতা বুলবুল আহমেদ চরিত্রায়ন করেছিলেন।এরপর বিদেশে চলে এলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো টেলিফোনে। একবার তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী পালন হলো ঘটা করে। আমরা আমেরিকা থেকে ফোন করি তাঁর বাসায়। এতোদিন পরেও ’সেলিম ভাই, শুভ জন্মদিন, হ্যাপী বার্থ ডে’ এটুকু বলার সংগে সংগেই বলেন, সেজান কেমন আছো? তৃষ্ণার কি খবর? আমাদের আরও আবাক হবার পালা!
তাঁর মতো মহান শিল্পী প্রত্যেককে নানাভাবে অবাক করবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। বাংলাভাষার নাটকে তাঁর অবস্থান যথার্থই কোথায় তা নির্ধারণ করা হলে আরও অবাক হতে হবে আমাদের। তিনি নাটকের আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন, ধ্রুপদীধারার সঙ্গে আধুনিক অনুসঙ্গ বিনির্মানে কখনও আশ্রয় নিয়েছেন প্রাচীন উপকথার, কখনও জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দর্শনের তত্ত্বজ্ঞানের ভান্ডারকে রুপকাশ্রয়ী করে গেঁথেছেন গল্পের বুনন। তাঁর প্রথমদিকের নাটকে কালমুখীনতা লক্ষ্যনীয় থাকলেও, শেষেরদিকের কাজে কালবিরোধীতার লক্ষন দেখা যায়। এর থেকে অনুমান করি যে তিনি তাঁর নিজের সৃজনশীলতার নিরিক্ষাতেও নাটকের মতই ক্লাইমেক্সের বা চূড়ান্ত পর্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হা হতস্যি, সেই কাজ শেষ হবার আগেই থমকে গেল তাঁর জীবনের ’চাকা’।
আমরা জানি সেলিম আল দীন এক সংগে অনেকগুলো রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ক্রনিক রোগগুলো এরকমই, একটা বাসা বাঁধলে অন্যগুলোও মেহমানের মতো আসে, জুড়ে বসে। তাছাড়া তাঁর মতো নিয়ম-মাফিক-চলা মানুষের মধ্যেও অনেক অনিয়ম জীবনের অনিবার্য সংগী হয়ে ছিল। সৃজনশীল কাজের নিত্য সংগী ’স্ট্রেস’, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্য হূদরোগের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। তাঁর জন্য সেটাই স্বাভাবিক। এও জানি তাঁকে চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন জাগে কেন এই প্রস্তুতি নিতে হয় জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে? কেন বন্ধু-বান্ধব, শিল্পীদেরই প্রিয়জন হারানোরোধে শেষ মুহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে সব জোগার করতে হয়, যখন আর কিছুই করার থাকে না? আমরা কি জাতীয় পর্যায়ে কোন দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না? প্রতিষ্ঠা করতে পারি না কোন ফাউন্ডেশন যা জাতীয় সম্পদের মতো প্রতিভাবানদের অসুস্থতার দূঃসময়ে অর্থ জোগান দেবে? অন্তত পক্ষে ততদিন যতদিন আমাদের নিজের দেশে সুচিকিৎসার সব ব্যবস্থা পর্যাপ্তভাবে থাকছে না। এক্ষেত্রে বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এগিয়ে আসতে পারে। নাকি তারাও ঢাকা থাকবে মাত্রাহীন মুনাফার ঘেরাটোপে?
সেলিম আল দীন চিরকালের মতো চলে গেছেন। সংগে নিয়ে গেছেন বাংলা ভাষায় আরেকটি নোবেল পুরস্কার পাবার সম্ভাবনা। কিম্বা কে জানে তাঁর ওপর গবেষণায় হয়তো দেখা যাবে সে সম্ভাবনার বীজ এখানেই নিহিত আছে। এ আমার আতিশয্য নয়, নির্মোহ ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। শুধু দেখার পালা তাঁর বিশ্বজনীন আবেদনকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিভা কোথায়! ফরাসি-আলজেরিয়ান লেখক, দার্শনিক, নাট্যকার আলবিয়ার কাম্যু’র একবার বলেছিলেন,

"Accept Life, take it as it is? Stupid. The means of doing otherwise? Far from our having to take it, it is life that possesses us, and on occasion shuts our mouths."

জীবনের কাছে আত্নসমর্পন করে জীবনকে মেনে নেয়াই ভালো, নাকি জীবনকে খুঁড়ে নিতে হবে জীবনেরই নির্যাস?, একথার উত্তরও দেবে সেলিম আল দীনের নাটক, এখানেই তাঁর মহৎ কালজয়ীতা।


জানুয়ারি ১৮, ২০০৮ ইউ, এস, এ

*লেখাটি পূর্ব প্রকাশিত